এত খারাপ সময় দেখিনি, বলছেন শাল বিক্রেতারা

গায়ে চাদর জড়িয়ে বসে এক মনে টিভিতে খবর দেখছিলেন বছর সাতষট্টির মিরাজউদ্দিন। মাস দেড়েক হল তিনি শ্রীনগর থেকে কৃষ্ণনগরে ফিরে এসেছেন। সেই থেকে আর বাড়ির কারও মুখ দেখেননি।

Advertisement

সুদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৪০
Share:

খবরে চোখ মিরাজ ও গোলামের। শনিবার কৃষ্ণনগরে। নিজস্ব চিত্র

সকাল থেকে সূর্যের দেখা মেলেনি। জাঁকিয়ে পড়েছে শীত। কনকনে ঠান্ডায় খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে পা রাখেননি কেউ। কৃষ্ণনগর কোর্ট মোড়ে কাশ্মীরি শাল দোকানেও খরিদ্দার নেই।

Advertisement

গায়ে চাদর জড়িয়ে বসে এক মনে টিভিতে খবর দেখছিলেন বছর সাতষট্টির মিরাজউদ্দিন। মাস দেড়েক হল তিনি শ্রীনগর থেকে কৃষ্ণনগরে ফিরে এসেছেন। সেই থেকে আর বাড়ির কারও মুখ দেখেননি। অন্য বার ফেসবুক বা হোয়াটসআপের ভিডিয়ো কল মারফত রোজই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কিন্তু গত ৫ অগস্ট, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের দিন থেকে কাশ্মীরে ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে। চলছে শুধু ফোন।

এমনিতেই মনমেজাজ ভাল নেই মিরাজের। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার রাত পর্যন্ত নদিয়া জেলায় নেট বন্ধ থাকায় এক টুকরো কাশ্মীরই যেন ফিরে এসেছে তাঁর কাছে। এখানেও যে এমন হতে পারে, তা যেন তিনি ভাবতেই পারছেন না।

Advertisement

মিরাজ বলেন, ‘‘ইন্টারনেট নির্ভর এই দুনিয়ায় নেট বন্ধ মানে কাজকর্ম শিকেয় ওঠা। কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক মানুষই আপৎকালীন সময়ে ভিডিয়ো কলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা বিপদে পড়ে গিয়েছেন। কাশ্মীর থেকে অনেকেই দেশে বা বিদেশে কাজের প্রয়োজনে বা পড়তে যান। তাঁদের সঙ্গে বাড়ির সবাই ভিডিয়ো কলে যোগাযোগ করেন। তাঁদেরও দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ।’’

শাল বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, বাইরে থেকে কাশ্মীরে কাজে আসা অনেকেই খাবার আনানো থেকে শপিং, সবই নেটেই সারতেন। সে সব বন্ধ। ব্যাঙ্কের কাজ চলছে বটে, কিন্তু লেনদেনের মেসেজ আসছে না মোবাইলে। গ্যাসের ভর্তুকির মেসেজও ঢুকছে না। দু’মাস সমস্ত মোবাইল পরিষেবাই বন্ধ ছিল। এখন শুধু পোস্টপেড পরিষেবা চালু হয়েছে। কিন্তু নেট বন্ধ থাকায় ক্ষতি হচ্ছে পড়াশোনারও।

আক্ষেপ করে মিরাজ বলেন, ‘‘মাস দুই আগে চণ্ডীগড়ে পিএইচডি করার জন্য নাম উঠেছিল আমার ছেলে সবুরের। কিন্তু নেট না থাকায় মেল দেখা যায়নি। যখন জানা গেল, তখন ভর্তি শেষ। এ বার আর ওর ভর্তি হওয়া হল না।’’

শহরের তুলনায় আরও খারাপ অবস্থা গ্রামের। শ্রীনগর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে বান্দিপোরা গ্রামে স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়েকে রেখে এসেছেন শাল বিক্রেতা গোলাম আহমেদ। তাঁর কথায়, ‘‘এমন খারাপ পরিস্থিতি আগে কখনও হয়নি। এই কঠিন সময়ে ওরা কেমন আছে, সব সময়ে বুঝতেও পারি না। মোবাইল ঠিক মতো কাজ করে না। কখনও ফোন লাগে, কখনও লাগে না। ওদের মুখটুকুও দেখতে পাই না।’’

ধাক্কা খেয়েছে ওঁদের কারবারও। গোলামের আক্ষেপ, ‘‘বহু বছর ধরে কৃষ্ণনগরে আসছি শাল বিক্রি করতে। কাশ্মীরে যখন থাকি, অনেক ক্রেতাই হোয়াটসআপ-মেসেঞ্জারে যোগাযোগ রাখেন। কী ধরনের পোশাক নিয়ে আসতে হবে তার বরাত দেন। এ বার নেট বন্ধ থাকায় তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেন নি।’’

এখন আবার নাগরিকত্ব আইন নিয়ে অবরোধ-আন্দোলনের জেরে যান চলাচল ব্যাহত হওয়ায় শহরের বাইরের অনেক ক্রেতা ওঁদের দোকানে আসতে পারছেন না। গোলাম জানান, গ্রামের দিকের অনেক খরিদ্দারই এখনও আসেননি। আগের বারের চেয়ে এখনও অন্তত ৪০ শতাংশ কম।

শ্রীনগরের থেকে আসা আর এক শাল বিক্রেতা মহম্মদ আমিন আসছেন গত ২৭ বছর ধরে। বিরস মুখে তিনি শুধু বলেন, ‘‘এতগুলো বছরে এতটা খারাপ সময় আর দেখিনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন