হাসপাতালের বদলে ভরসা কলার ভেলায়

ছেলেকে নেতিয়ে পড়তে দেখেও তাঁকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করতে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছোননি বাবা-মা। কোনও চিকিৎসকের শরণাপন্নও হননি। অথচ, তাঁরা বিশ্বাস রেখেছিলেন কলার ভেলায়!

Advertisement

সুস্মিত হালদার ও সন্দীপ পাল

কালীগঞ্জ ও চন্দননগর শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:২০
Share:

শোকার্ত: মৃত বালকের পরিবার। নিজস্ব চিত্র

ছেলেকে নেতিয়ে পড়তে দেখেও তাঁকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করতে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছোননি বাবা-মা। কোনও চিকিৎসকের শরণাপন্নও হননি। অথচ, তাঁরা বিশ্বাস রেখেছিলেন কলার ভেলায়!

Advertisement

কালীগঞ্জের ফরিদপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ফুলতলা গ্রামে গত রবিবার রাতে বারো বছরের সূর্য রায় মারা যায় বিষধর সাপের ছোবলে। বাবা-মা দিবাকর ও অনিমা রায়ের দাবি, কাটোয়া হাসপাতালে ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার পথেই তাঁরা বুঝতে পারেন, সূর্যর দেহে আর প্রাণ নেই। তাই হাসপাতালে যাননি। মাঝপথ থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। সোমবার সকালে কলার ভেলা সাজিয়ে তাতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন ছেলের দেহ। আশা ছিল, মঙ্গলকাব্যের লখিন্দরের গল্পের মতো তাদের ছেলেও ভেলায় ভাসতে-ভাসতে বেঁচে উঠবে। বুধবার সেই ভেলা গিয়ে আটকায় হুগলি জেলার চন্দননগরের রানির ঘাটে। বালকের মৃতদেহে ততক্ষণে পচন ধরতে শুরু করেছে। সেখান থেকেই খবর দেওয়া হয় নদিয়া পুলিশকে।

চিকিৎসক, যুক্তিবাদীদের একাংশ হাসপাতালে না গিয়ে সূর্যকে নিয়ে বাবা-মায়ের বাড়ি ফিরে আসার ঘটনায় স্তম্ভিত। এক চিকিৎসক বলেই ফেলেন, ‘‘রোগী মারা গিয়েছে কিনা সেটা তো চিকিৎসক পরীক্ষা করে বলবেন, সেটা সাধারণ লোকের পক্ষে বোঝা সেই ভাবে সম্ভব নয়। হয়তো ছেলেটির দেহে তখনও প্রাণ অবশিষ্ট ছিল। হাসপাতালে এনে অ্যান্টি স্নেক ভেনাম দিয়ে শেষ চেষ্টা করা যেত। সেই সুযোগটা তার নিজের বাবা-মা দিলেন না। অথচ কলার ভেলায় আস্থা রাখলেন!’’

Advertisement

এর কারণ কি সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারানো? হাসপাতালে গেলে অ্যান্টি স্নেক ভেনাম মিলবে না, রেফার হওয়াটাই ভবিতব্য—এটা ভেবেই কি শেষ চেষ্টার জন্য আর হাসপাতালে যাননি দিবাকর ও অনিমা?

কালীগঞ্জের বাড়িতে বসে বিলাপ করতে করতে অনিমা বলেন, ‘‘অত কিছু ভাবিনি। কাটোয়া হাসপাতাল যাওয়ার পথে ছেলেটা তো হাতেই মরে গেল। আমরা সবাই তো দেখলাম। তখন আর হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে গিয়ে লাভ কি? বরং অলৌকিক তো অনেক কিছুই হয়। ধর্মে নাকি আছে যে সাপে কামড়ে মৃত মানুষকে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়ার পরে বেঁচে উঠেছে। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশায় আমরাও তাই করেছিলাম। কিন্তু হল না।” রাজ্যের সাপের কামড়ের চিকিৎসার জন্য গঠিত টাস্ক ফোর্সের অন্যতম সদস্য চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদারের কথায়, ‘‘অ্যান্টি স্নেক ভেনামের যথেষ্ট জোগান রাজ্যের সর্বত্র রয়েছে। এটা খুব দুঃখজনক যে কিছু মানুষ এখনও বস্তাপচা কুসংস্কার আঁকড়ে রয়েছেন।’’

কয়েক বছর আগে জেলা সদর কৃষ্ণনগরের কাছেই হরনগর এলাকায় একই ভাবে সাপে কাটা এক শিশুকে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন পরিজনেরা। সে বারও পচতে শুরু করা মৃতদেহ ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল তাঁদের। সম্প্রতি কালীগঞ্জের ওই এলাকায় রাতের অন্ধারে এক শিশুকে একই ভাবে নদীর ধারে রেখে গিয়েছিলেন পরিবারের লোকজন। চন্দননগরের বাসিন্দা ৭০ বছরের বৃদ্ধা সাবিত্রী বন্ধ্যোপাধ্যায় সকালে খবর পেয়েই গঙ্গার ঘাটে কলার ভেলায় মৃত শিশু দেখতে ছুটে এসেছিলেন। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘ আধুনিক যুগেও যে মানুষ কত কুসংস্কার নিয়ে বাঁচছে আজ বুঝলাম।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন