রানাঘাট রেলগেটের কাছে সেই ফ্লেক্স। ছবি: প্রণব দেবনাথ
নদিয়ায় প্রশাসনিক বৈঠক করতে এসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, জাতীয় সড়কের দুরবস্থার দায় যে রাজ্যের নয় তা রাস্তার পাশে ফ্লেক্স টাঙিয়ে জানাতে।
রানাঘাট উত্তর-পশ্চিমের বিধায়ক শঙ্কর সিংহকে জাগুলিয়া থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে ফ্লেক্স টাঙাতে বলেন মমতা। এই রাস্তাটি যে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের (ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অব ইন্ডিয়া) অধীন তা জানিয়ে রাস্তার এই অবস্থার জন্য দুঃখপ্রকাশ করার নির্দেশও দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
সেই মতো জেলার মধ্যে দিযে চলে যাওয়া ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ৬৬ কিলোমিটার অংশে তিনশো ফ্লেক্স লাগানো হয়েছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘আমরা দুঃখিত এই রাস্তার দুরবস্থার জন্য’ এবং ‘বহুবার অনুরোধ সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার এই রাস্তা মেরামত করেনি, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি’। যে কোনও বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার রীতি হল, তাতে কে এই বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে তার উল্লেখ থাকে। কিন্তু এই ‘আমরা’ কারা, তার উল্লেখ ফ্লেক্সে নেই।
হবিবপুরে প্রশাসনিক বৈঠকে বিধায়ককে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ফলে মনে হতে পারে, ‘আমরা’ মানে রাজ্য সরকার। কিন্তু ফ্লেক্স টাঙানো হয়েছে তৃণমূলের খরচে এবং উদ্যোগে। রবিবার শঙ্কর সিংহও বলেন, ‘‘দলনেত্রীর নির্দেশে দলের তরফে ফ্লেক্স টাঙানো হয়েছে।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই, লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলের এই প্রচারে ক্ষুব্ধ বিজেপি। দলের নদিয়া উত্তর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি মহাদেব সরকারের কটাক্ষ, “ওঁরা সরকার আর দল এক করে ফেলেছেন!’’ তাঁর দাবি, ‘‘জমি অধিগ্রহণের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তৃণমূলের তরফে নানা ভাবে বিরোধিতা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বারবার চেষ্টা হলেও রাজ্যের আন্তরিকতার অভাবেই কাজ আটকে গিয়েছে।”
শঙ্কর পাল্টা বলেন, “কেন্দ্রের সদিচ্ছা না থাকাতেই জাতীয় সড়কের এই হাল। ফোর লেন হওয়া তো দূরের কথা, সংস্কারের অভাবে জাতীয় সড়ক বেহাল। তাই মানুষের বিভ্রান্তি কাটাতে প্রকৃত সত্যটা জানানো হল।”
প্রশ্ন হল, সত্যিই কেন এই দুরবস্থা জাতীয় সড়কের? কার কতটা দায়? ভবিতব্যই বা কী?
জাগুলিয়া থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত ৬৬ কিলোমিটার রাস্তার দীর্ঘদিন ধরেই জায়গায়-জায়গায় বেহাল। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ মাঝে-মধ্যে অস্থায়ী ভাবে সংস্কার করলেও কিছু দিনের মধ্যেই তা ফের পুরনো চেহারায় ফিরে যায়। কৃষ্ণনগর থেকে পলাশি পর্যন্ত ফোর লেনের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এলেও অংশের কাজ থমকে আছে।
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সাল থেকেই সড়ক সম্প্রসারণের পাশাপাশি শুরু হয়েছিল সংস্কারের জন্য টেন্ডার সংক্রান্ত নানা প্রক্রিয়া। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত ‘প্যাকেজ ১’-এ মোট প্রায় ৮৪ কিলোমিটার রাস্তা। তারই প্রায় ৬৬ কিলোমিটার পড়েছে নদিয়ায়। ‘মধুকন প্রোজেক্ট লিমিটেড’ নামে একটি নির্মাণ সংস্থা ২০১২-র অগস্টে ‘প্যাকেজ ১’-এর নির্মাণকাজ শুরু করে। চুক্তি ছিল, ৯১০ দিন অর্থাৎ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু জমি আন্দোলন ও মামলা-মোকদ্দমার জেরে না পাওয়ায় তারা ঠিক সময়ে জমি পায়নি। তার ফলে কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে এবং খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে জানিয়ে তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়।
তখন ঠিক হয় রাজ্যের পূর্ত দফতর বারাসত থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত ‘ফোর লেন’ রাস্তা তৈরি করবে। সেই মতো ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাদের সরকারি ভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার অংশে জমি অধিগ্রহণের কাজ থমকে থাকায় ঠিক হয়, নদিয়ার ৬৬ কিলোমিটার রাস্তার কাজ আগে হয়ে যাবে। পূর্ত দফতর নতুন ভাবে ১৫১০ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। কিন্তু তার অনুমোদন এখনও আসেনি।
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই প্রকল্পের অনুমোদন দেবে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কৃষ্ণনগর প্রোজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন ইউনিটের প্রকল্প অধিকর্তা সৌতম পাল বলেন, “আমাদের কাছে যা খবর, তাতে এক-দেড় মাসের মধ্যেই আমরা অনুমোদন পেয়ে যাব। তার পরেই টেন্ডার ডেকে দ্রুত কাজ শুরু করে দেওয়া হবে।”
তা যদি সত্যিও হয়, লোকসভা নির্বাচনের আগে যে কাজ শুরু করা যাবে না, তা কার্যত স্পষ্ট। ফলে তত দিন জাতীয় সড়ক নিজের চেহারাতেই থাকবে, দুঃখপ্রকাশও থাকবে।