Bhai Phota

Bhatridwitiya: প্রতিপদের ভাইফোঁটায় লুকিয়ে বর্ষার নদীর গল্প

কিন্ত বঙ্গদেশের অন্যতম লোকপ্রিয় এই সামাজিক পার্বণ পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রতিপদ এবং দ্বিতীয়া মিলে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বহুকাল থেকে।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২১ ০৮:২৪
Share:

প্রতীকী ছবি।

বোনের বিয়ের পরই পাল্টে গিয়েছিল ফোঁটার রেওয়াজ। বোনের শ্বশুরবাড়ি লোকেরা পূর্ববঙ্গের মানুষ হওয়ায় তাঁদের ভাইফোঁটা হত প্রতিপদে। চিরকাল ভাইফোঁটার দিনে ফোঁটা নিতে অভ্যস্ত নবদ্বীপের বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত শুভেন্দু সিদ্ধান্ত প্রথম বার খুব অবাক হয়েছিলেন।

Advertisement

বর্ষীয়ান শুভেন্দুবাবুর কথায়, “আমরা এ দেশীয়, ফলে আমাদের পরিবারে ভাইফোঁটা হত প্রথামাফিক দ্বিতীয়ায়। কিন্তু বোনের শ্বশুরবাড়ি পূর্ববঙ্গীয়। ফলে, ওকে সেই পরিবারে নিয়ম মানতে হল। প্রথম বার আগের দিন ফোঁটা হবে শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম।” তখন থেকেই প্রতিপদে ফোঁটা পান তিনি।

প্রতিপদে ভাইফোঁটা শুনে অবাক অনেকেই হতে পারেন। কিন্ত বঙ্গদেশের অন্যতম লোকপ্রিয় এই সামাজিক পার্বণ পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রতিপদ এবং দ্বিতীয়া মিলে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বহুকাল থেকে। উপলক্ষ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হলেও উদ্‌যাপনে ফারাক অনেকটাই। ফোঁটা দেওয়ার দিন ক্ষণ তিথি থেকে শুরু করে ফোঁটা দেওয়ার সময়ে বলা ছড়া, ফোঁটার উপকরণ ইত্যাদির মধ্যে দুই বঙ্গের বেশ কিছুটা গরমিল আছে। বাংলা পঞ্জিকা মতে, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হিসেবে চিহ্নিত। সাধারণত ভাইফোঁটা এ দিনই হয়। যাদের প্রতিপদে ফোঁটা, তাদের নিয়ম ভিন্ন। সে ক্ষেত্রে ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা’র মতো বহুশ্রুত ছড়া বদলে যায়। হয়ে যায়— ‘প্রতিপদে দিয়ে ফোঁটা দ্বিতীয়াতে নীতা, আজ হতে আমার ভাই যম দুয়ারে তিতা।’

Advertisement

পাঠান্তরে ‘নিতে’ এবং ‘তিতে’। শুভেন্দুবাবু বলেন, “নীতে শব্দের আভিধানিক অর্থ নিমন্ত্রণ। যার মানে দাঁড়াচ্ছে প্রতিপদে ভাইকে ফোঁটা দেবে বোন। পর দিন দুপুরে ভাইবোনের এই পুনর্মিলন উপলক্ষে হবে জমজমাট ভূরিভোজ। প্রতিপদে ফোঁটার কারণ আমি যেটুকু বুঝেছি, তাতে ভাইকে আরও একটা দিন বেশি কাছে পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে না চাওয়ার উদ্দেশ্যে দুই দিনে উৎসবকে বাড়িয়ে দেওয়া।” কিন্তু এ দেশীয় শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও বাপের বাড়ির রীতি মেনে প্রতিপদে এখনও দাদাকে ফোঁটা দিয়ে চলেছেন সুতপা মুখোপাধ্যায়। পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্ট থেকে সেই কোন ছোট বেলায় নবদ্বীপে এসেছিলেন সুরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী। পরবর্তী কালে যিনি নবদ্বীপ সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তিনি প্রয়াত হয়েছেন বহু কাল আগে। কিন্তু তাঁর পরিবারে সেই পূর্ববঙ্গীয় প্রথা এখনও বজায় আছে যথারীতি। তাঁর মেয়ে সুতপা দেবীর বিয়ে হয়েছে বেলপুকুরে এ দেশীয় মুখোপাধ্যায় পরিবারে। তবুও তিনি দাদাকে ভাইফোঁটা দিতে প্রতিপদেই আসেন। দাদা অজয় চক্রবর্তী বলেন, “আমার বাবা এবং মা দু’জনেই পূর্ববঙ্গের। ফলে, শুধু বোন নয় মাকেও দেখেছি মামাদের প্রতিপদে ফোঁটা দিতে। ফোঁটা দেওয়ার সময় মা বলতেন—প্রতিপদে দিয়ে ফোঁটা দ্বিতীয়াতে খাইয়ো নীতা।”

পর দিন অর্থাৎ দ্বিতীয়ার দুপুরে কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার শুরুতে একটা প্রথার কথা শোনালেন অজয়বাবু। বললেন, “দুপুরে খাওয়ার শুরুতে ঘি গরম ভাত মেখে তিনটি মণ্ড তৈরি করে মামাদের হাতে দিতেন মা। বোনও একই প্রথা মেনে আমায় দেয়।”

তখন বোনেদের বলতে হয়— ‘‘ভ্রাতস্তবানুজাতাহং ভুঙক্ষভক্তমিদং শুভম্। প্রীতয়ে যমরাজস‍্য যমুনায়া বিশেষতঃ।’’ বোন ভাইয়ের অগ্রজ হলে শব্দটা হয় ‘ভ্রাতস্তবাগ্রজাতাহং’।’’

কিন্তু একই সামাজিক উৎসব অঞ্চল ভেদে এমন ভিন্ন ভিন্ন ধারায় পালিত হওয়ার নজির বড় একটা নেই তেরো পার্বণের বাংলাদেশে। ভাইফোঁটা কেন ব্যতিক্রমী ভাবে এক দিন এগিয়ে এল, সে প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা একেবারেই অন্য রকম।

যে পূর্ববঙ্গে ভাইফোঁটা প্রতিপদে দেওয়া হয়, তা নদীমাতৃক। যাতায়াতের ভরসা নৌকা। ভাইফোঁটা যে সময়ে হয়, তখনও সদ্য শেষ হওয়া বর্ষার নদী ফুলেফেঁপে একাকার। ফোঁটা নিতে দিনের দিন এসে ফিরে যাওয়া ছিল কার্যত অসম্ভব। তাই আগের দিন ভাইদের ফোঁটা দিয়ে লোকাচারের পর্বটুকু সেরে রাখতেন বোনেরা। পর দিন শুধুই খাওয়া দাওয়া। বছরে একবারই ব্যস্ত ভাই ততোধিক ব্যস্ত বোনের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলে কাটাতেন প্রতিপদের রাত।

পর দিন মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে ভাইধনের নাও খানি ভেসে পড়ত ভাটি গাঙ বাইয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন