কৌশিক ও শ্যামল।
ওঁদের দুপুর নেই, বিকেল নেই। ওঁদের পুজো নেই, ঈদ নেই, ছুটিছাটা নেই।
মাঠ আছে। হুইসল আছে। আছে ছেলেমেয়ের দল, আর বেদম উৎসাহ।
বিকেলে স্কুল ছুটি হলেই বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন কৌশিক স্যার। কী ভাবে গোলপোস্টের তেকাঠিতে বল রাখতে হয়, কী ভাবে ডিফেন্সে গড়তে হয় চিনের প্রাচীর, প্রতিটি খুঁটিনাটি ছেলেদের বুঝিয়ে চলেন তিনি।
ধানতলার হিজুলী শিক্ষানিকেতনে (উচ্চ মাধ্যমিক) ক্রীড়া শিক্ষক কৌশিক বিশ্বাসের স্বপ্ন ছিল, বড় ফুটবলার হবেন। আন্তঃজেলা ও আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে খেললেও, তার বেশি আর যাওয়া হয়নি। নিজের অপূর্ণ স্বপ্নই তিনি রোজ বীজের মতো ছড়িয়ে চলেন স্কুলের মাঠে।
জলঙ্গির সাগরপাড়া হাইস্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক শ্যামল মণ্ডলও প্রায় একই গোত্রের মানুষ। তাঁর মুনশিয়ানা অ্যাথলেটিক্সে। মধ্য-পঞ্চাশ পেরিয়েও তিনি অক্লান্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছেন মাঠ জুড়ে। নিজেও পড়তেন এই স্কুলেই। তাঁর মনে পড়ে, ১৯৮০-তে স্কুলের হয়ে জেলাস্তরে দ্বিতীয় ও প্রথম হয়েছিলেন তিনি ও তাঁর বন্ধু দিলীপ ঘোষ। সেই খুশিতে স্কুলে এক দিন ছুটি দেওয়া হয়েছিল। সেই ব্যাটন তিনি এখনও ছাড়েননি। এই সাধনার ফলও ফলছে হাতে-নাতে। মাত্র তিন বছর আগে গুটি কয়েক পড়ুয়া নিয়ে ধানতলার স্কুলে যে পথচলা শুরু হয়েছিল, সেখানে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সত্তরে। মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং রবিবার চলছে প্রশিক্ষণ। গ্রীষ্ম বা পুজোর ছুটিতেও ছাড় নেই। স্কুলের অনূর্ধ্ব ১৭ দল পরপর তিন বার জেলা চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। অনূর্ধ্ব ১৪ দল জেলাস্তরে সেমিফাইনাল খেলেছে।
সাগরপাড়ার স্কুলের রোকেয়া খাতুন ৪০০ মিটার দৌড়ে রাজ্যে প্রথম হয়েছে। নন্দিতা, প্রিয়াঙ্কারা শর্টপাট, রিলে রেসে রাজ্যস্তরে যোগ দিয়েছে। মাসিদুল মোল্লা, গৌরচন্দ্র দাস, মানিক সরকার জাতীয় স্তরে গিয়েছে গত দু’বছরে। আন্তঃস্কুল ক্রীড়ায় জেলাস্তরে সব প্রতিযোগিতায় শ্যামল স্যারের ছাত্রছাত্রীরা। এ বছর জেলা থেকে রাজ্যস্তরে সুযোগ পেয়েছিল মোট ১৬ জন, তার মধ্যে ৮ জনই ছিল সীমান্তের এই স্কুলটির। মহকুমা স্তরে ৩২টি প্রতিযোগিতার মধ্যে শুধু প্রথম স্থানেই ছিল ২১ জন।
শ্যামল স্যার সাগরপাড়ার লোক হলেও এক সময়ে শিক্ষকতা করতেন কলকাতার কানখুলি বয়েজ স্কুলে। সপ্তাহে এক দিন ছুটিতে বাড়ি ফিরে অনুশীলন করাতেন। ২০০৫ সালে চালু করেন ক্যাম্প। পরে বদলি হয়ে নিজের স্কুলে এসে ২০১২ থেকে পুরোদমে লেগে পড়েছেন।
কৌশিক স্যারের বাড়ি চাকদহের শিমুরালি সুতারগাছি গ্রামে। ১৭ বছর আগে তিনি ধানতলার স্কুলে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর ফুটবল অ্যাকাডেমি চালু হয়েছে বছর তিন আগে কয়েকটি ছাত্রের উৎসাহে। তার জন্য অবশ্য মূল্য দিতে হয় অনেক। সকলের জুতো-মোডা কেনারও পয়সা নেই। দ্বাদশ শ্রেণির সুরজিৎ সরকার বলে, “স্যারই আমাদের জুতো, মোজা, বল কিনে দিয়েছেন। নইলে তো প্রশিক্ষণই নিতে পারতাম না।” ছাত্রছাত্রীদের জন্য জুতো, গেঞ্জি, অন্য সব সরঞ্জাম কিনতে হয় শ্যামল স্যারকেও।
এ রকম এক-এক জন খিদ্দা না থাকলে কোনিরা আসবে কী করে!