দুয়ারে মাধ্যমিক

ডিজে-র হুঙ্কারে লাটে উঠেছে পড়াশোনা

খেলার মাঠ থেকে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসেছিল করিমপুরের স্বাতী পাল। ঠিক তখনই পাড়া কাঁপিয়ে শুরু হল ডিজে। আওয়াজ রুখতে জানলা দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল ঠিকই। কিন্তু ডিজে-র আওয়াজকে অবহেলা করা কি সহজ কথা! স্বাতীর কথায়, ‘‘কান ঝালাপালা করছে। পড়ব কী করে?’’

Advertisement

কল্লোল প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:২৭
Share:

বিয়ে বাড়িতে চলছে ডিজে বক্স।নিজস্ব চিত্র

খেলার মাঠ থেকে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসেছিল করিমপুরের স্বাতী পাল। ঠিক তখনই পাড়া কাঁপিয়ে শুরু হল ডিজে। আওয়াজ রুখতে জানলা দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল ঠিকই। কিন্তু ডিজে-র আওয়াজকে অবহেলা করা কি সহজ কথা! স্বাতীর কথায়, ‘‘কান ঝালাপালা করছে। পড়ব কী করে?’’

Advertisement

একই দশা বহরমপুরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মৌমিতা কর্মকারের। সেখানেও শত্তুরের নাম সেই ডিজে। মৌমিতা বলছে, ‘‘বাড়ির পাশেই অনুষ্ঠান বাড়ি। সেখানে প্রায় দিনই কোনও না কোনও অনুষ্ঠান চলছে। আর চলছে ডিজে। সামনে যে পরীক্ষা সে হুঁশ কারও নেই।’’

ডিজে-তাণ্ডব শুরু হয়েছে সেই নভেম্বরের শেষ থেকে। মাঝ ফেব্রুয়ারিতেও থামার কোনও ইঙ্গিত নেই। পিকনিক, পার্টি, অন্নপ্রাশন কিংবা বিয়ে— অন্য কিছুর কমতি হোক বা না হোক, ডিজে চাই-ই চাই। গাঁ-গঞ্জ, মফস্‌সল কিংবা শহরে এখন এটাই যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

দুয়ারে কড়া নাড়ছে মাধ্যমিক। চলছে মাদ্রাসা বোর্ড পরিচালিত একাধিক পরীক্ষা। মার্চে শুরু হবে উচ্চ মাধ্যমিক। ঘরে ঘরে পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতি তুঙ্গে। এ দিকে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ে চোখ রেখেও কিছুই মাথায় ঢুকছে না পরীক্ষার্থীদের। সৌজন্যে ডিজে। দুই জেলা জুড়ে রোজ দিনই লেগে রয়েছে পিকনিক, বিয়ে, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন-সহ নানা অনুষ্ঠান। আর ওই সব অনুষ্ঠানে তারস্বরে বাজছে ডিজে।

পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, শব্দবিধির তোয়াক্কা না করেই দিনরাত এই শব্দ দানবের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হতে হচ্ছে। সেই নভেম্বর থেকে এই অত্যাচার চলছে। ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারছে না। বাড়িতে কষ্ট পাচ্ছে অসুস্থ ও বয়স্ক লোকজন। অথচ প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ করছে না।

পরীক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা—সকলেই সমস্বরে জানাচ্ছেন, আনন্দ করতে তো কেউ নিষেধ করছে না। তাই বলে কোনও মাত্রা থাকবে না? পড়ুয়াদের পড়াশোনা তো শিকেয় উঠছে। শিকারপুরের এক পড়ুয়া বলছে, ‘‘দিনকয়েক পরেই মাধ্যমিক। আর এরই মধ্যে পাড়ার লাগাতার অনুষ্ঠান লেগেই রয়েছে। মন দিয়ে পড়তেই পারছি না।’’

তেহট্টের এক ব্যক্তির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, ‘‘সামনেই মেয়ের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। কিন্তু গভীর রাত পর্যন্ত ডিজের দাপাদাপি। নিষেধ করতে গেলে কেউ তো কথা শোনেই না, উল্টে অপমান করে নইলে
হুমকি দেয়।’’

মুর্শিদাবাদের অলোক দাসের কথায়, ‘‘অনুষ্ঠান মানেই যেন তারস্বরে ডিজের গান। ওই আওয়াজে বুক ধড়ফড় করে। পরীক্ষার্থী ও অসুস্থ লোকজনের কথা ভেবে প্রশাসনের উচিত এ ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ করা।’’ এমন অবস্থায় উদ্বিগ্ন শিক্ষকেরাও। যমশেরপুর বিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ক’দিন আগেও স্কুলের পাশে পিকনিকের আওয়াজে ক্লাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। নিষেধ করলেও কেউ শুনতে চায় না। এখন আবার শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান বাড়ির শব্দ।’’

পুলিশ জানিয়েছে, গত কয়েক দিনে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাইক বাজানোর মৌখিক অভিযোগ মিলেছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পদক্ষেপও করেছে। কিন্তু এই ধরনের অনুষ্ঠানে তো মাইক বাজানোর অনুমতিই নেই। তাহলে পুলিশের সামনেই শব্দবিধি ভেঙে এমন তাণ্ডব চলছে কী করে?

তেহট্টের এসডিপিও কার্তিক মণ্ডল বলেন, “কারও বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানালে কড়া ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। পরীক্ষা শুরুর আগে শব্দের বিরুদ্ধে পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় প্রচারও চালাবে।’’ একই বক্তব্য মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশেরও। কিন্তু পরীক্ষার আগে প্রস্তুতিটাই তো মাঠে মারা যাচ্ছে। এখন থেকেই প্রচার চালাতে অসুবিধা কোথায়? নাহ্, সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন