সিলিং ভরা সূর্য তারা, দেওয়াল ভরা বন

শ্রেণিকক্ষের ভিতরে হাতি, গাছ কিংবা আপেলের আদলে ব্ল্যাকবোর্ড। পাখার পাশেই সূর্যকে কেন্দ্র করে বনবন করে ঘুরছে বুধ, শুক্র, পৃথিবী। গাছপালা চেনাতে স্কুলের বাগানে সব্জির সঙ্গে লাগানো হয়েছে হরেক রকম ফুল-ফলের গাছ।

Advertisement

সামসুদ্দিন বিশ্বাস ও সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৭ ০৩:২৮
Share:

আনন্দে: স্কুলে এখন খেলতে খেলতেই পড়ে পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ব্যাগটা মেঝের উপরে ছুড়ে ফেলে ধপাস করে বসে পড়েছিল রিঙ্কি খাতুন।

Advertisement

তৃতীয় শ্রেণির ওই ছাত্রী গোমড়া মুখে তার মাকে জানিয়েছিল, ‘‘স্কুলে যেতে ভাল্লাগে না! খালি অঙ্কে ভুল হচ্ছে।’’

দ্বিতীয় শ্রেণির মিঠুন বিশ্বাস আবার বলেছিল, ‘‘ইস! পড়াটাও যদি খেলার
মতো হতো!’’

Advertisement

খুদেদের এই ভাল না লাগা, কষ্ট কি শিক্ষকেরাও বুঝতে পেরেছিলেন?

নদিয়া মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু স্কুলের উদ্যোগ অন্তত তেমনটাই বলছে। আস্ত স্কুলটাই যেন একটা রঙিন পড়ার বই। সিঁড়ির ধাপে ধাপে একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ...। সেই সঙ্গে বার ও মাসের নাম। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে করতে কবে কবে সে সব মুখস্থও হয়ে গিয়েছে পড়ুয়াদের।

শ্রেণিকক্ষের ভিতরে হাতি, গাছ কিংবা আপেলের আদলে ব্ল্যাকবোর্ড। পাখার পাশেই সূর্যকে কেন্দ্র করে বনবন করে ঘুরছে বুধ, শুক্র, পৃথিবী। গাছপালা চেনাতে স্কুলের বাগানে সব্জির সঙ্গে লাগানো হয়েছে হরেক রকম ফুল-ফলের গাছ। কৃত্রিম জলাশয়ে ভাসছে জলজ উদ্ভিদ। মাঝে মধ্যেই লাফ দিয়ে ঝপাং করে পড়ছে মাছ, ব্যাঙ।

হরিহরপাড়ার ট্যাংরামারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অসীম অধিকারী মুচকি হাসছেন, ‘‘এখন কাউকে পড়ার কথা বলতে হয় না। স্কুলে উপস্থিতির হার বেড়েছে।’’

গত কয়েক বছরে মুর্শিদাবাদের লালবাগ, হরিহরপাড়া, বেলডাঙা কিংবা নদিয়ার রানাঘাটের দয়াবাড়ি, চাকদহের চালিতাপালি স্কুলের চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। বলা ভাল, বদলে দিয়েছেন উৎসাহী কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ। মুর্শিদাবাদ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান দেবাশিস বৈশ্য বলছেন, “জেলার বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় নিজেদের উদ্যোগে এমনটা করেছে। এটা প্রশংসনীয় তো বটেই। সেই সঙ্গে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রমাণ করে দিয়েছেন, ইচ্ছে থাকলেই বহু কিছু করা যায়।’’

লালবাগের শিশু ভারতী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্ল্যাকবোর্ডেও নতুনত্বের ছোঁয়া। শিক্ষক জানতে চাইছেন, ‘‘বলো তো, হাতির পেটে কী?’’

সমস্বরে উত্তর এল—‘তিন দু’গুণে ছয়।’

পাশের ক্লাসে আবার পড়ুয়াদের মুখ বইয়ে নয়, ছাদের দিকে। শিক্ষকও বলে চলেছেন, ‘ওই দেখো, সূর্যের সবথেকে কাছের গ্রহ বুধ, শুক্র...।’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুজয় চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “পড়তে ভাল না লাগলে রয়েছে গল্প বলার ক্লাস। এখন আর কেউ বাড়িতে গিয়ে ‘ভাল্লাগে না’ বলে।’’ হরিহরপাড়ার ট্যাংরামারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া মোর্তজা কামাল, তৃতীয় শ্রেণির সৌরভ বিশ্বাসরা এখন বলছে, ‘‘আমরা তো এখন খেলতে খেলতেই পড়ি।’’

রানাঘাটের দয়াবাড়ি প্রাথমিক স্কুলেও মাথার উপরে ঘুরছে চাঁদ-সূর্য, দেওয়ালে ছুটছে বাইসন। গাছগাছালিতে ঘেরা স্কুলটার সিঁড়ির ধাপেই রয়েছে বর্ণপরিচয়, ধারাপাত। দেওয়াল জুড়ে ছবি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমরেশ বিশ্বাস জানাচ্ছেন, সিলেবাসকে মাথায় রেখেই সমস্ত ছবি আঁকানো হয়েছে। চোখের সামনে সর্বক্ষণ সেই ছবি দেখতে দেখতে পড়ুয়ারাও সহজেই সব কিছু রপ্ত করে ফেলছে। নদিয়ায় অবশ্য এমন স্কুল এই প্রথম নয়। বীরনগরের ঊষাগ্রামে ১৯৭৪ সালে বিদ্যানিকেতন শিশুবিহার নামে এমনই স্কুল গড়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী। সেই স্কুল এখনও চলছে তাঁর দেখানো পথেই। নেদারল্যান্ড, জাপান ও জার্মানিতে ওই একই রকমের স্কুল তৈরি হয়েছে। চাকদহের চালিতাপালি প্রাথমিক স্কুলে আবার ক্লাস চলছে প্রজেক্টারের মাধ্যমে।

পাখিপড়া করে আর কাউকে কিছু বোঝাতে হচ্ছে না। সাদা পর্দায় পাখি উড়ছে। মনের আনন্দে আঁক কষছে পড়ুয়ারাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন