ফাইল চিত্র।
কথাটা বেশ কিছু দিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল— একটা ই-ম্যাগাজিন বের করলে কেমন হয়, যেখানে পড়ুয়ারা করোনা পরিস্থিতিতে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরবে? তাদের সামনে বদলে যাওয়া সমাজ, বদলে যাওয়া প্রকৃতিকে তুলে ধরবে। তুলে ধরবে সেই সব বিষয় যা তাদের চোখে ধরা পড়বে।
সেই ভাবনা থেকেই কৃষ্ণনগর হাইস্কুলে করোনা আবহের মধ্যেই পড়ুয়াদের নিয়ে ই-ম্যাগাজিন তৈরির কাজ শুরু করেছেন প্রধান শিক্ষক উৎপল ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “ছকের বাইরে ভাবার জন্য বিরাট দিগন্ত খুলে দিয়েছে করোনাভাইরাস। নিজের মত করে প্রকৃতি সব কিছুকে আবার গুছিয়ে নিচ্ছে। আমরা চাই, মোবাইল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্যের চোখে নয়, ছেলেরা নিজের চোখে চারপাশটাকে দেখুক।”
এই করোনা কালে শিক্ষকদেরও সুযোগ এসেছে পড়ুয়াদের নিজের মত করে দেখার চোখ তৈরি করে দেওয়ার, তাদের উৎসাহিত করার। কিন্তু সেই কাজটা কতটা করছেন শিক্ষকরা? নদিয়ার একেবারে প্রান্তিক এলাকার শিকারপুর হাইস্কুলের শিক্ষক দীপক সাহা বলছেন, “এখন পড়ুয়াদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ নেই। বিশেষ করে আমাদের এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা তেমন না থাকায় অনলাইন ক্লাসও করা যাচ্ছে না। যাদের সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছে, তাদের শুধু একটা কথাই বলছি যে ‘ব্যাক টু নেচার’। প্রকৃতির কোলে আমাদের ফিরে যেতে হবে।” তিনি জানান, তাঁদের স্কুলে ২৭ বিঘা জমি রয়েছে। ইচ্ছে আছে, স্কুল খুললে পড়ুয়াদের দিয়ে এমন সব গাছপালা লাগাবেন যাতে .নানা পতঙ্গ আসে, প্রজাপতি আসে।
অনেকেই মনে করছেন যে বিগত একশো বছরের মধ্যে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন গুরুত্বপূর্ণ খুব কম ঘটনাই ঘটেছে যা শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের সমাজ, চিন্তা, চেতনা, মননের উপর এমন সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের অপ্রতুলতার কারণে বিরাট সংখ্যক পড়ুয়ার কাছে যে অনলাইন ক্লাস নিয়ে পৌঁছনো যায়নি তা স্বীকার করে নিয়ে ফুলিয়া শিক্ষা নিকেতনের শিক্ষক অনিন্দ্য মোদক বলছেন, “চাইলেও পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে তাদের নিজের মত করে চারপাশটা দেখে নিজের মত করে শিক্ষা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে পারছি না। তবে যাদের সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছে তাদেরই বলছি, এটা একটা বিরাট সুযোগ চারপাশটাকে দেখে নেওয়ার, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার।”
কিন্তু সেই সুযোগই কোথায় পড়ুয়াদের? যাদের পেট চালানোর কথা না ভেবে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করার মত সঙ্গতি আছে, তাদেরও বদ্ধ ঘরে ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোনে ক্লাস করতে করতেই কেটে যাচ্ছে দিন। জানালা দিয়ে চারপাশটা দেখার সুযোগ কোথায়? শিক্ষক অরুপ সরকার যেমন বলছেন, “যখন প্রথম চিনে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল তখন থেকই আমি ক্লাসে পড়ুয়াদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কেন প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করা উচিত নয়, করলে কতটা বিপদের মুখে পড়তে হবে। স্কুল খুললে এই বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি বেশি করে কথা বলব ছাত্রদের সঙ্গে।”
যমশেরপুর বিএম হাইস্কুলের শিক্ষক দুর্বাদল দত্ত যোগ করেন, “আমি পড়ুয়াদের এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি এবং ভবিষ্যতেও করব যে ঠিক কী করণে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যাচ্ছেন, কারও কারও ক্ষেত্রে উপসর্গ প্রবল ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে কেন, তাঁরা মারা না গেলেও কষ্ট পাছেন, আবার কেন সংক্রমিত হয়েও কারও কারও ক্ষেত্রে কোনও উপসর্গ প্রকাশ পাচ্ছে না। ওরা যদি শুধু এটুকুই বুঝতে পারে, অনেকটা কাজ হয়ে যাবে। প্রকৃতির শৃঙ্খলা না মানলে কী পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়, সেটাই এই সময়ের শিক্ষা।”