বৃষ্টি-ভাসি ফেসবুক, ভাঁজ তবু চাষির কপালে

সবে মেঘটা কালো হয়ে এসেছে। ঝড়টা তখনও আসব আসব করছে। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে কি পড়েনি, ঠিক তখনই ঝমঝম করে ফেসবুকে শুরু হল পোস্ট-বর্ষণ! —‘বৃষ্টি নামে মেয়েটি শেষ পর্যন্ত তাহলে সাইকেল পেল!’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৬ ০২:৩৭
Share:

সবে মেঘটা কালো হয়ে এসেছে। ঝড়টা তখনও আসব আসব করছে। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে কি পড়েনি, ঠিক তখনই ঝমঝম করে ফেসবুকে শুরু হল পোস্ট-বর্ষণ!

Advertisement

—‘বৃষ্টি নামে মেয়েটি শেষ পর্যন্ত তাহলে সাইকেল পেল!’

—‘তবে সাইকেলে গতি কিন্তু বিশেষ ভরসা দিচ্ছে না ভাই’

Advertisement

—‘চড়েছে যত, থেমেছে তার বেশি। এ তো বৃষ্টির অপমান রে!’

মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরে বৃষ্টি যা হয়েছে তাতে মাটির সোঁদা গন্ধটুকুও কারও নাকে যায়নি। কিন্তু তাতে কী! বৃষ্টিকুচি মেখে হোয়াটসঅ্যাপ- ফেসবুক এক্কেবারে কাকভেজা। যদিও এমন ছিটেফোঁটা বৃষ্টিতে খুশির কোনও কারণই দেখছেন না চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত লোকজন। তাঁদের মতে, শেষ বৈশাখে এসে এই ঢিমে তেতালা ছন্দের বৃষ্টি নিয়ে এমন ‘আদিখ্যেতার’ কোনও মানেই হয় না।

‘নিন্দুকেরা’ যা বলছে বলুক। কার তাতে কী? সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বৃষ্টি বন্দনার বিরাম নেই। জনৈক রজনী মানসী লিখছেন, “বলেছিলাম করেছি মান ডাকবো না আর তোরে/ এ বার আমার মান ভাঙিয়ে হৃদয় দিবি ভরে/ রিমঝিমিয়ে এলি রে তুই গেলি আমায় ছুঁয়ে, মান অভিমান মিশে গেলো এক আর একে দুয়ে।”

তিনটি বৃষ্টির ছবির কোলাজের সঙ্গে পোস্টের শেষে তিনি লিখেছেন, “প্রথম তোকে জড়িয়ে মুঠোয় নিলাম রে তোর ঘ্রাণ। হৃদয় আমার উঠলো গেয়ে বৃষ্টি ভেজা গান। গায়ে মেখে সোহাগ দিয়ে বললি এ বার আসি। তোর সুরে আর ছন্দে বলি—তোকে বড্ড ভালবাসি।”

সেই পোস্টের পরে জনৈক তমাল ঘোষ লিখেছেন, “ডাকছি আমি, ডাকো তুমি/ ডাকুক সবাই খুব জোরে/ আয় বৃষ্টি, আয় বৃষ্টি আয় রে ভীষণ মেঘ করে/ সারাটা দিন জ্বলছি পুড়ছি, ক্লান্তি আসছে খুব ঘেমে/ আয় বৃষ্টি, আয় বৃষ্টি এখুনি আয় নেমে।” সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই। নিজের নিজের মোবাইলে বৃষ্টি বা ঝড়ের ছবি তুলে সঙ্গে বর্ষার গানের দু’-একটি লাইন। ব্যস। যেন আস্ত গীতবিতানটাই তুলে আনতে পারলে শান্তি হয়।

সব দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেননি গায়ক কালিকাপ্রসাদ। মিতভাষী গায়ক তার ফেসবুকে লিখেছেন, “ছিটেফোঁটা এল আর বাঙালির কাব্য চয়ন শুরু হয়ে গেল। ভাগ্যিস ফেসবুক ছিল, নইলে কত প্রতিভা অধরাই র‍য়ে যেত।” প্রায় সাতশো ‘লাইক’ পড়লেও অনেকেই যে গায়কের এই কথায় বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন তা কমেন্টস দেখেই মালুম হচ্ছে।

একজন তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, ‘‘আমরা নিজেরা নিজেদের খোঁচা মেরে কেন কথা বলি একটু বলতে পারেন?’’ বাঙালি অন্যের কিছু সহ্য করতে পারে না বলে কাঁকড়ার গল্প শুনিয়ে তিনি দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করেছেন। আর একজনের মন্তব্য, ‘‘অল্প বৃষ্টিতেই সাহিত্য হয়। বন্যায় হয় না।’’ আর এক ক্ষুব্ধ বন্ধুর কমেন্ট, ‘‘এই আবেগটা আছে বলেই তো আমরা আপনাদের অসাধারণ ভেবে মাথায় তুলে রাখি। এটা থাকতে দিন।” সব দেখে বাচিকশিল্পী ঊর্মিমালা বসু লিখেছেন, “অমন বলতে নেই। এমনিতেই কত কবি মরে যায় একা একা। এক্ষেত্রে মেরে মরছে। সহ্য কর।” বাদ প্রতিবাদের মাঝে পরে বেচারা বৃষ্টির কথা কেউ বলে না। শেষমেশ কালিকাপ্রসাদ ‘হোক হোক কাব্য হোক’ বলাতে শান্ত হয়েছেন কবিকুল।

কালো আকাশের প্রেক্ষাপটে এলোমেলো নারকেল পাতার ছবি। ঝড়ের তাণ্ডবে গাছে ঝুলছে আম। এমন ছবির পাশাপাশি কেউ কেউ আবার লিখেছেন, ‘‘মেঘের গর্জনই সার। বৃষ্টি কোথায়? এর থেকে শনিপুজোর শান্তিজলও পরিমাণে বেশি হয়।” বৃষ্টি-ব্যাঙ্গেও জমজমাট ওয়াল থেকে ওয়াল। অল্প বৃষ্টি দেখে কেউ পোস্ট করেছেন, ‘‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ৬০ এমএল মেপে।” দেওয়া হয়েছে ব্যাঙের বিয়ের ছবিও।

তবে বৃষ্টির এই দশা নিয়ে উদ্বিগ্ন জেলার কৃষি দফতরের কর্তা ও চাষি উভয়েই। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ২৭.৬ মিলিমিটার। মে মাসে এখনও পর্যন্ত ৮.২ মিলিমিটার। যেখানে গত বছরে শুধু এপ্রিল মাসেই বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৫০ মিলিমিটার। জেলার এক কৃষি কর্তা বলছেন, ‘‘কালবৈশাখী বা প্রাক মৌসুমী বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে পাট এবং আমনের বীজতলা। এ বার সব শুকনো। সামান্য বৃষ্টিতে যেটুকু মাটি ভিজল তাতে মাঠে নামার ভরসা পাবেন কৃষক। এইটুকুই যা লাভ।”

বৃষ্টি যে পথ না ভুলে নড়বড়ে সাইকেলে এ দিকেই আসছে, সেটাই যা ভরসার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন