তৃপ্ত হোক...। মঙ্গলবার সকালে নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
শুধু পুজো নয়, পাঁজির বিধানে বিপত্তি বেধেছিল মহালয়ায় তর্পণ নিয়েও। পঞ্জিকা মতে এবার অমাবস্যা শুরু হয়েছে মঙ্গলবার সকাল ৯ টা ২৪ মিনিটে। ফলে তার আগে না পরে কখন তর্পণ করা উচিত এ নিয়ে বিতর্কের শেষ ছিল না। নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটে বহু মানুষ ৯টা ২৪ মিনিটের পরেই তর্পণ করেছেন। সাত সকালে তর্পণ সেরে কলকাতা যাওয়ার ট্রেন ধরেছেন, এমন বহু লোকেরও দেখা মিলেছে। অবশ্য এই ভাগাভাগিতে ভিড়ের চাপও ভাগ হয়ে স্বস্তি পেয়েছেন সকলেই।
তর্পণ হল শিকড়ে ফেরার অনুষ্ঠান। কেউ কেউ বলেন স্মরণ উৎসব। আমাদের অতীতকে স্মরণ করা হয় এই লোকাচারের মাধ্যমে। পিতৃপক্ষ আসলে প্রিয়পক্ষ। বিশ্বাস করা হয় এই সময় পরলোকগত প্রিয়পরিজন আবার ফিরে আসেন মর্ত্যের মায়ায়। আর তাদের জীবিত উত্তরসূরীরা তাঁদের জলদান করে তৃপ্ত করেন। সেই ‘তৃপ’ ধাতু থেকেই তর্পণ। প্রবীণ সংস্কৃতজ্ঞ ভাগবত পাঠক গোরাচাঁদ ভট্টাচার্য বলেন, “তর্পণের মন্ত্র বলছে ওঁ আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্তং জগত্তৃপ্যতু।” অর্থাৎ এ দিন শুধু যে পিতৃপুরুষকে শ্রদ্ধা জানানো হয় তা নয়। সমগ্র ভূ অর্থাৎ অতীত এবং আমার পূর্বের যাবতীয় প্রাণকে যেন সশ্রদ্ধ আমন্ত্রণ জানানো হয়। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “মহালয়া শব্দের একটি অর্থ আনন্দ নিকেতন। মনে করা হয়, যে সব প্রিয়জনেরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাঁরা এই সময়ে নিজ ধামে আসেন। তাঁদের উপস্থিতিতে গৃহ আনন্দময় হয়ে ওঠে।”
মঙ্গলবার সকালে বহরমপুরে গঙ্গার ঘাটে ছবিটি তুলেছেন গৌতম প্রামাণিক।
মধ্যযুগে যখন নবদ্বীপের নব্যন্যায়ের খ্যাতি সারা দেশজোড়া, তখন থেকেই এখানে তর্পণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হত। সেই ধারাই চলে আসছে। নবদ্বীপ রানির ঘাটে দাঁড়িয়ে মহালয়ার সকালে এলাকার কাউন্সিলর মিহিরকান্তি পাল বলেন, “লক্ষাধিক মানুষ এ দিন নবদ্বীপে তর্পণ স্নান করেন।” তাঁরা যাতে সুষ্ঠভাবে সব কাজ করতে পারেন তাঁর জন্য পুরসভা এবং এলাকার ছেলেরা তৎপর আছে।
ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই ঘাটে পুণ্যার্থীদের আনাগোনা। সকাল যত গড়ায় ভিড়ের চাপে হারিয়ে যায় ঘাটের ধাপ। রানির ঘাট থেকে কয়েক পা দূরেই এক বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রম। তার রাস্তা লাগোয়া বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছেন একদল নারী পুরুষ। বিহ্বল চোখে দেখছেন সামনের রাস্তায় তর্পণের ভিড়। গাড়ির পর গাড়ি থেকে সপরিবার নামছেন প্রতিষ্ঠিত ছেলের দল। তর্পণের সঙ্গে একদিনের অন্য রকম একটা ট্যুরও বটে। সব দেখে প্রায় ফুঁপিয়ে ওঠেন এক বৃদ্ধ, “সারা জীবন অপমান মুখঝামটা দিয়ে, মরার পর এখন মন্তর পরে জল দিলেই কি সব মাপ হবে বাবা? অতই সহজ!”
অন্য দিকে, ৪৬ বছর ধরে রেডিও মেরামতির কাজ করছেন রূপেন কর্মকার। তিনি জানাচ্ছেন, বছরভর রেডিও বন্ধ থাকে, এই একদিনই কেবল চালানো হয়। বললেন, “এবারে সব মিলিয়ে সাত আটটা সেট মেরামত করেছি।” তাঁর আক্ষেপ, “এখন আর রেডিও শোনেন ক’জন? লোকজন তো টিভির মহালয়া নিয়ে বেশি মাতামাতি করেন। অথচ একটা সময় ছিল মহালয়ার আগের রাতে রেডিও ঠিক করে দিতে পারিনি বলে বন্ধু বিচ্ছেদ পর্যন্ত হয়েছে। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে বাদ দিয়ে আবার পুজো আসে নাকি!”