কিশোরদের হাতেও মদ, চুপ পুলিশ

আইন আছে খাতা-কলমে! কিন্তু বাস্তব বলছে অন্য কথা। অভিযোগ, বয়সের কোনও বাছবিচার না করেই দেদার বিকোচ্ছে দিশি কিংবা বিলিতি মদ।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:৪১
Share:

আইন আছে খাতা-কলমে! কিন্তু বাস্তব বলছে অন্য কথা।

Advertisement

অভিযোগ, বয়সের কোনও বাছবিচার না করেই দেদার বিকোচ্ছে দিশি কিংবা বিলিতি মদ। কলকাতা-সহ জেলা কিংবা প্রত্যন্ত এলাকাতেও ছবিটা একই রকম। কলকাতার সানি পার্কে আবেশ দাশগুপ্তের মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ। মদ নিয়ে উঠে এসেছিল নানা মতামত। সেই ঘটনার পরে পুলিশের দাবি ছিল, বেআইনি মদ বিক্রি বন্ধ করতে ও অল্পবয়সীরা যাতে মদ কিনতে না পারে সে জন্য কঠোর নজরদারিও চলছে।

কিন্তু সেই নজরদারি যে নেহাতই কথার কথা তা ফের প্রমাণ করে দিল নদিয়ার কৃষ্ণনগরের ঘটনা। শনিবার রাতে শহরের একটি দিঘির পাড়ে মাটি খুঁড়ে পুলিশ নবম শ্রেণির এক পড়ুয়ার দেহ উদ্ধার করেছে। বছর পনেরোর ওই পড়ুয়াকে খুনের অভিযোগে
তারই দুই নাবালক বন্ধুকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত ও ধৃতেরা শুধু সে দিনই নয়, মাঝেমধ্যেই নির্জন ওই দিঘির পাড়ে মদ খেতে যেত।

Advertisement

আবগারি আইন বলছে, দোকান থেকে মদ কিনতে হলে বয়স হতে হবে ২১ বছর। প্রশ্ন হচ্ছে, এই নাবালকেরা তাহলে মদ কিনত কী ভাবে? যাদের কাছ থেকে তারা মদ কিনত পুলিশ কি তাদের খুঁজে পেয়েছে? নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলছেন, ‘‘ওই নাবালকদের যারা মদ বিক্রি করত তাদের আমরা খুঁজে বের করবই। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’’

কৃষ্ণনগরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশের এমন ফাঁকা আশ্বাস তাঁরা আগেও শুনেছেন। এর আগে, কৃষ্ণনগরেই মদের ঠেকে নাবালক খুন হয়েছে। তখনও পুলিশ কড়া পদক্ষেপের কথা বলেছিল। কিন্তু সে সব কিছুই হয়নি। এলাকার লোকজন বলছেন, ‘‘সবার আগে এই মদ বিক্রির ব্যাপারে রাশ টানতে না পারলে এমন ঘটনা বেড়েই চলবে।’’

মদ বিক্রির ক্ষেত্রে প্রশাসনের কেমন নজরদারি চলছে?

বেশ কিছু মদের দোকানে ঢুঁ মেরে দেখা গিয়েছে, কারও এখনও ঠিকমতো গোঁফের রেখা স্পষ্ট হয়নি। কারও থুতনিতে সামান্য দাড়ির আভাসে উপচে পড়ছে অহঙ্কার। ফুলপ্যান্টে এখনও অভ্যস্ত নয় তাদের অনেকেই। অথচ কাউন্টারের ও-পারে দাঁড়িয়ে বয়ঃসন্ধির ভাঙা গলা নিয়ে তারা কখনও চেয়ে নিচ্ছে— ‘একটা হাফ দিন তো!’ কখনও আবার নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নাম করে অর্ডার দিচ্ছে। নির্লিপ্ত মুখে মদের দোকানদারও তাদের এগিয়ে দিচ্ছেন মদ।

আর ‘অপ্রাপ্তবয়সে’ এমন প্রাপ্তিযোগই ঘটিয়ে দিচ্ছে একের পর এক অঘটন। কৃষ্ণনগরের মনে এখনও টাটকা ২০১৪ সালের মার্চ মাসের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি। এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে যাবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল একাদশ শ্রেণির ছাত্র অতনু মণ্ডল। তারপর সে আর বাড়ি ফেরেনি। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের ওই মেধাবী ছাত্র খুন হয়েছিল মদের ঠেকে। গত বছর শান্তিপুরে সরস্বতী পুজোর দিন পরিকল্পনা করে মদ খাইয়ে এক নাবালককে খুন করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল।

রাজ্য জুড়ে এমন ঘটনার অভাব নেই। নদিয়া জেলা পুলিশের এক কর্তাও কবুল করছেন, ‘‘নাবালকদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। একাধিক খুনের ঘটনায় জড়িত নাবালকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আর প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনায় অনুঘটকের কাজ করেছে মদ!’’

জেলা আবগারি দফতরের সুপার সৌরভ ভদ্র বলছেন, ‘‘জেলার লাইসেন্সপ্রাপ্ত মদ বিক্রেতাদের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া রয়েছে— ২১ বছরের নীচে কাউকে মদ বিক্রি করা যাবে না। কেউ বিক্রি করলে খবর পেলেই তাঁর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থাও নিই।’’

ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেন লিকার অফ অ্যান্ড অন শপ ওনার্স অ্যাসোশিয়েশনের নদিয়া জেলার শাখা সম্পাদক মিহির চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘আমরা নাবালকদের মদ বিক্রি করি না। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে আইন মেনে মদ কিনে কেউ যদি বেআইনি ভাবে সেই মদ বিক্রি করেন তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। সেটা দেখার দায়িত্ব আবগারি দফতর ও পুলিশের।’’

জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘আমরাও তো বসে নেই! আবগারি দফতরের পাশাপাশি আমরাও তো নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।’’ অথচ সেই অভিযানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রমরমিয়ে কারবার চালাচ্ছে বেআইনি মদ বিক্রেতাও। জেলা সদর বহরমপুর কিংবা কৃষ্ণনগরে এখন এক ফোনেই মিলছে মদ। সেখানে কোনও বয়স, পরিচয় লাগে না। শুধু লাগে ঠিকানা। আর মদের নির্ধারিত মূল্যের থেকে সামান্য কিছু বেশি টাকা দিলেই ঘরেই পৌঁছে যাচ্ছে মদ।

সন্ধ্যার পরে বাইক কিংবা সাইকেলে শহরে ছুটে চলেছে চলমান মদের দোকান। তামাম শহর সে কথা জানে। চোখে পড়ে না শুধু প্রশাসনের!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন