পিছন থেকে শ্রীখোলা বলল, ফের এস কিন্তু

পুজোর ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায়..., ভাবতে ভাবতে মাথায় এল সান্দাকফু-ফালুট ট্রেকের কথা। ফেসবুকে ‘চলুন বেড়িয়ে আসি’ (Let’s Go & Enjoy Nature) নামে একটি পেজ-এ আলাপ হয়েছিল একটি ঘোরা-পাগল দলের সঙ্গে।

Advertisement

সৌমেন জানা

কান্দি শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩০
Share:

লেক ধরে।

পুজোর ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায়..., ভাবতে ভাবতে মাথায় এল সান্দাকফু-ফালুট ট্রেকের কথা।

Advertisement

ফেসবুকে ‘চলুন বেড়িয়ে আসি’ (Let’s Go & Enjoy Nature) নামে একটি পেজ-এ আলাপ হয়েছিল একটি ঘোরা-পাগল দলের সঙ্গে। ওদের সৌজন্যেই আট জনের সঙ্গে পরিচয় হল। এরাই হল আমার ট্রেকের সঙ্গী।

পরিকল্পনামাফিক ১৬ অক্টোবর সবাই মিলে হাজির হলাম এনজেপি স্টেশনে। কেউ কাউকে চিনি না। প্রথম দেখা ওই স্টেশনেই। শুনতে অবাস্তব লাগলেও, এটাই সত্যি। কেউ এসেছেন গুয়াহাটি থেকে, কেউ বেহালা, কেউ আবার বগুলা থেকে। কারও বয়স ৩০ তো কারও ৫৫। এ রকম একটা দলের সঙ্গে কী করে দীর্ঘ পঞ্চান্ন কিলোমিটার ট্রেক করব, ভেবে বেশ চিন্তাই হচ্ছিল।

Advertisement

পরের দিন সবাই একটা ভাড়ার গাড়ি করে পৌঁছলাম মানেভঞ্জন। তার পর সেখান থেকে এক জন গাইডকে নিয়ে দু’টো ল্যান্ডরোভারে চেপে রীতিমতো বাপ-ঠাকুর্দার নাম করতে করতে পৌঁছলাম কালিপোখরি।

পথে পড়ল মেঘমা, চিত্রে, তুম্বলিং। মন ভুলিয়ে দেওয়া সবুজ পাহাড়। যত উপরে উঠছি, ঠান্ডাটাও টের পেতে শুরু করলাম।

পাহাড়ের ঢালে।

কালিপোখরি একটি ছোট্ট গ্রাম। এখানে একটি ‘পবিত্র পুকুর’কে ঘিরে পর্যটন গড়ে উঠেছে। গাইডের কাছে জানলাম, এই পুকুরটি নাকি ত্রেতা যুগে আরও কালো জলে পূর্ণ ছিল। কলি যুগে সেই রং ফিকে হয়েছে।

১৮ অক্টোবর সকালে আমাদের ট্রেক শুরু হল। কালিপোখরি থেকে সান্দাকফু ৬ কিলোমিটার খাড়া রাস্তা। স্নায়ুর চাপ আর শরীরের ক্লান্তি দু’টোই উপলব্ধি করলাম হাঁটতে হাঁটতে। পথে বিখেভঞ্জনে খানিক চা খেয়ে নিলাম।

এর মধ্যেই কিন্তু সবাই বেশ কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছে। হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব দেখে কে বলবে সদ্য আলাপ? বিকেলে সূর্যাস্তের সময় মনটা খারাপ হয়ে গেল। কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘেঢাকা। যেন কিছুতেই আমাদের কাছে তিনি ধরা দিতে চায় না।

১৯ তারিখ ফালুটের দিকে হাঁটা শুরু করলাম আমরা। একুশ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা। পথের ধারের সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করল। কোথাও সবুজ উপত্যকা, কোথাও আবার হিমালয়ের বরফে ঢাকা চুড়ো আকাশে উঁকি মারছে। আমরা যে রাস্তা ধরে হাঁটছি, তার এক পাশ নেপালে। অন্য দিকটা আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। বিকেলে পৌঁছলাম ফালুট। শরীরের ক্লান্তি আর মনের প্রশান্তি মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল।

পরের দিন ঘড়িতে তখন ভোর চারটে। হুলুস্থুলু পড়ে গেল বাংলোতে। সূর্যোদয় দেখতে যেতে হবে। কোনও মতে গায়ে জ্যাকেট-সোয়েটার চাপিয়ে ছুটলাম সবাই। বাংলো থেকে ১ কিলোমিটার খাড়াই বেয়ে যখন ফালুটের মাথায় উঠলাম, তত ক্ষণে ঠান্ডায় সবাই জমে বরফ। সেই সঙ্গে হাড় হিম করা ঠান্ডা হাওয়ায় স্রোত।

কিন্তু সেই সব অনুভূতি নিমেষে উধাও। চোখের সামনে যে দিগন্তজোড়া হিমালয়। ঝকঝকে নীল আকাশের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাউন্ট এভারেস্ট। মাকালু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে আর থ্রি সিস্টারস। তারা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ফালুট টপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সরাসরি দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। সবাই মিলে তৈরি করেছে ‘স্লিপিং বুদ্ধা’। মন ভরে এ দৃশ্য দেখার পরে রওনা দিলাম গোর্খের দিকে। ১৬ কিলোমিটার হাঁটার পর পৌঁছলাম পাহাড়ে ঘেরা এই গ্রামটাতে। পাতে দেশি মুরগির ঝোল আর মিষ্টি নেপালি গান— শরীরের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল। পরের দিন, অর্থাৎ ২১ অক্টোবর পৌঁছলাম শ্রীখোলাতে। পথে পড়ল ঘন জঙ্গল। রাস্তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঝর্ণা। তারা আপন মনে বয়ে চলেছে। পথে ধারে ফুটে রয়েছে রঙবাহারি ফুল।

শ্রীখোলাতেই আমাদের যাত্রা শেষ। এ বার ঘরে ফেরার পালা। বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে একে একে রওনা দিলাম নিজ নিজ গন্তব্যে। বিদায় জানানোর একে অপরকে এক রকম কথাই দিয়ে এলাম... ফের দেখা হবে বন্ধু। এমনই কোনও পাহাড়ের ঢালে। আর পিছন থেকে শ্রীখোলা যেন বলল, আবার আসছ তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন