তারের জট। প্রাঙ্গণ মার্কেটে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
পোড়া গন্ধটা নাকে ঠেকতেই চমকে যান সকলে। তার পরই চোখে পড়ে মিটার বক্সে ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে নিমেষে। দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয় ট্রান্সফর্মার। তাতেই অবশ্য চার তলা মার্কেট কমপ্লেক্স ‘প্রাঙ্গন’-এর আগুন আয়ত্তে আসে, কিন্তু মঙ্গলবারের ওই ঘটনার পর থেকেই মনের মধ্যে দানা বেঁধেছে ভয়।
বিশেষ করে সংবাদপত্রে সুলতানপুরের সেই ভয়াবহ ছবি দেখার পর। পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে মাটির ঘর। দুপুরে রাঁধা ভাত পুড়ে ছাই। অভুক্ত শিশুকে কোলে নিয়ে দাওয়ায় বসে রয়েছেন মা। চোখে শূন্যদৃষ্টি। পিছনে দাঁড়িয়ে পোড়া ঘরের কাঠামোটুকু।
ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ‘প্রাঙ্গন’-এর প্রতি তলায় আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় জলের বন্দোবস্ত রয়েছে। এমনকী চারতলার ছাদে জরুরি ভিত্তিতে জলাধারও নির্মাণ করা হয়েছে। ওই সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে দমকল দফতর থেকেও মিলেছে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ও। দমকলের ওই শংসাপত্রকে অস্ত্র করে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া ‘প্রাঙ্গন মার্কেট’-এর প্রায় তিনশো ব্যবসায়ী রমরমিয়ে ব্যসা করছেন। যদিও কোথাও একটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রশ্নটা— ‘‘যদি আগুন লাগে, সব রক্ষা পাবে তো!’’
কারণ একটাই। দমকলের শংসাপত্র রয়েছে ঠিকই, কিন্তু দোকানিদের সচেতনতা কোথায়? দিনে দিনে গজিয়ে ওঠা দোকানঘরে কার্যত ‘জতুগৃহে’ পরিণত হচ্ছে প্রাঙ্গন মার্কেট। মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়েই যেমন কথা উঠছে। সপ্তাহের ওই দিন বহরমপুরের সমস্ত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সেই মত প্রাঙ্গন মার্কেটের সমস্ত দোকান বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু এ সপ্তাহে প্রাঙ্গন মার্কেট খোলা ছিল। যদিও কোনও ভিড় ছিল না। প্রশ্ন উঠছে এখানেই— অন্য দিন এ ঘটনা ঘটলে ব্যবসায়ীরা কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেন! মার্কেট বন্ধ থাকলেই বা কী হতো?
মার্কেটের একেবারে নীচের তলায়, যেখানে মিটারগুলি বসানো হয়েছে, সেই জায়গাটা প্রায় অন্ধকার। এর পাশ দিয়েই সাপের ফনার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে বিদ্যুতের তার। কখনও যে শর্ট সার্কিট হতে পারে, বড়-সড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে যেতে পারে, সে নিয়ে চিন্তা নেই কারও। মেইন লাইনের ওই জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা তো দূর অস্ত্! শেষ কবে সাফ-সুতরো হয়েছে, তা দেখে ঠাহর করা মুশকিল। প্লাস্টিক-কাগজের চায়ের কাপ, নাইলনের বস্তা, পিচবোর্ড, ছেঁড়া কাগজের বান্ডিল, পড়ে রয়েছে যত্রতত্র।
ঠিক এখান থেকেই বিদ্যুতের তার গোছা হয়ে চারতলা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। খোলা আকাশের নীচে দেওয়াল বেয়ে জড়ামড়ি করে উঠে যাওয়া বিদ্যুতের তার বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে বৃষ্টির জল। শুধু কি তাই! একই ভাবে দেওয়ালের গায়ে ইন্টারনেট, কেবল লাইনের তার। সেই সঙ্গে সিঁড়ির কোনায়, দেওয়ালের কোনে কোনে স্তুপাকারে পড়ে রয়েছে নোংরা-আবর্জনা। তাতে দাহ্য পদার্থেরও অভাব নেই। দোকান ঘরের মাপ অনুযায়ী স্কোয়ার ফুট পিছু হিসেব করে প্রতি মাসে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তোলা হয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। কিন্তু তার পরেও মার্কেট সুরক্ষিত রাখতে এত গাফিলতি কেন?
যদিও গাফিলতির কথা মানতে নারাজ সমিতির কর্মকর্তারা। সমবায় সমিতির সভাপতি দিলীপ লাহা বলেন, ‘‘আমরির ঘটনার পরেই অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে মার্কেট সুরক্ষিত রাখতে দমকলের কাছে আবেদন করে সব ধরনের পদক্ষেপ করা হয়েছে। সব দিক খতিয়ে দেখেই নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিয়েছে দমকল।’’ তবে অগ্নিনির্বাপনযন্ত্র চালানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রান্ত কোনও কর্মী নেই কেন? সে ক্ষেত্রে দিলীপবাবু জানান, ওই কর্মীর অভাব রয়েছে ঠিকই। এ জন্য সমিতির কয়েক জন সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নতুন করে দমকল দফতরের কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই প্রশিক্ষণ দিয়ে উঠতে পারেনি তারা।
কয়েক বছর আগে চার তলা পর্যন্ত অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র লাগানো হয়। কিন্তু তার পরে এক দিনেরও জন্য সেটি ব্যবহার করা হয়নি। সিঁড়ি বরাবর দেওয়ালের গায়ে প্রতিটি কোনায় লাগানো যন্ত্রগুলোর পানের পিক থেকে মরচে ধরে যাওয়ার দাগ। ফলে কোনও দিন প্রয়োজন, আদৌ ওগুলি কাজ করবে কি না, সন্দেহ রয়েছে তা নিয়েও। যদিও সমবায় সমিতির সম্পাদক সুবোধ সাহা বলেন, ‘‘আগুন সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের চোখ-কান খোলা রয়েছে। কী কী পদক্ষেপ করলে অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে মার্কেট সুরক্ষিত থাকবে, তার সবগুলিই করা হয়েছে।’’
এর আগে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার সময়ে কৃষ্ণনাথ রোডের উপর থেকে সমস্ত হকার উচ্ছেদ করে দেয় পুলিশ ও প্রশাসন। স্মৃতি থেকে মনে করে দিলীপবাবু বলেন, ‘‘তার পরেই তৎকালীন জেলাশাসক এন রামোজির কাছে দরবার করে আমাদের পুনর্বাসন দেওয়ার আবেদন করি। তখন জেলাশাসক আমাদের সমবায় সমিতি গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। সেই মতো সমবায় সমিতি গড়ে তোলা হয়। পরে ১৯৭৬ সালে তার রেজিস্ট্রেশনও হয়।’’ তার দু’বছর পরে জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর বর্তমান প্রাঙ্গন মার্কেট যে জায়গায় গড়ে উঠেছে, সেখানে প্রায় সওয়া দু’বিঘে জমি ৩৪ বছরের লিজে ওই সমবায় সমিতিকে দেয়।
তারও কয়েক বছর পরে ১৯৮৪ সালে ওই সমবায় সমিতি লিজের জায়গা বেসরকারি এক সংস্থার হাতে তুলে দেয়। ওই সংস্থা সেখানে চার তলা মার্কেট গড়ে দেয় সেটি হলো প্রাঙ্গন মার্কেট। ১৯৮৪ সালে কাজ শুরু হয় এবং চার তলা ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয় ২০০২ সালে। যদিও ভবন নির্বাণের সময়ে পরিকল্পনা পাশ করেছে পুরসভা। অভিযোগ, ভবন নির্মাণের পরে প্রয়োজন মতো মার্কেটের ভেতরে নতুন নতুন ঘর নির্মিত হয়েছে ব্যবসায়িক কারণে। কিন্তু পুরসভার কোনও অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, ‘‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি পুরকর্মীদের সরজমিনে খতিয়ে দেখে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি। অনুমোদন ছাড়াই কোনও নতুন নির্মাণ হলে পৌর-আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে।’’