চলছে নাটকের মহড়া। বহরমপুরের একটি স্কুলে। — নিজস্ব চিত্র
এই মুহূর্তে বহরমপুর শহরকে নাটকে পেয়েছে। এলাকার এগারোটি হাই স্কুলের পড়ুয়ারা এখন মেতে রয়েছে নাটকের মহড়ায়। আগামী শনিবার ও রবিবার বহরমপুর রবীন্দ্রসদনের মঞ্চে নাটক মঞ্চস্থ করবে স্কুলের ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা। বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটারের উদ্যোগে দু’দিন ধরে দুপুর ২টো থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সেখানে অনুষ্ঠিত হবে ‘বিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতা ও উৎসব ২০১৫’। এগারোটি স্কুল ছাড়াও থাকছে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের কয়েদিদের নাটক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতা কাহিনী’।
ওই নাটকের পরেও আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১১টি স্কুলের মধ্যে ৫টি স্কুলের পড়ুয়ারা নাটকের মহড়ায় ব্যস্ত থাকবে। গত এপ্রিল মাস থেকে আইসিআই, শ্রীগুরু পাঠশালা, গীতারাম অ্যাকাডেমি ও মোনার্ক স্কুল অব হিওম্যান এক্সসিলেন্স- এর বাংলা ও ইংরাজি বিভাগ মিলিয়ে মোট ৫টি স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়ে নাটকের কর্মশালা শুরু করেছে ‘বহরমপুর গাঙচিল’ নামে একটি নাট্যসংস্থা। সংস্থার কর্ণধার রাহুলদেব ঘোষের ব্যাখ্যা, ‘‘স্কুলের পাঠক্রমে নাটক অবশ্যপাঠ্য করার দাবি দীর্ঘ দিনের। গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের মতো কিছু রাজ্যের স্কুলের পাঠক্রমে নাটক অন্তর্ভূক্ত হলেও এ রাজ্য তা করেনি। সেই কারণেই আমাদের এই কর্মশালা। স্কুলের শিক্ষকরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।’’
আট মাসের ওই প্রকল্প শেষ হলে ফের নতুন ৫টি স্কুল বেছে নেওয়া হবে। রাহুলদেব বলেন, ‘‘ফের ৮ মাস পর আবারও অন্য ৫টি স্কুলে চলবে প্রশিক্ষণ। নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে পড়ুয়াদের কল্পনাশক্তি, ধীশক্তি, একাগ্রতা বাড়বে।’’ ‘বহরমপুর রবীন্দ্রমেলা’র উদ্যোগে মে মাসে সপ্তাহ দুয়েক ধরে বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রোৎসবে ৪টি স্কুলের ছাত্রীরা ৪টি নাটক মঞ্চস্থ করে। রঙ্গাশ্রমের সন্দীপ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় শিল্পমন্দির মঞ্চস্থ করে ‘বিম্ববতী’ কবিতার নাট্যরূপ, গাঙচিলের রাহুলদেব ঘোষের পরিচালনায় অভিনীত হয় গীতারাম অ্যাকাডেমির নাটক ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’, ঋত্বিকের রাজেন দাসের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় লিপিকা গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীদের প্রযোজনা ‘রাজরানি’ এবং ঋত্বিকের তরুণ সরকার নির্দেশিত মহাকালী পাঠশালার নাটক ‘অভিসার’।
গত ফেব্রুযারি মাসে জেএন অ্যাকাডেমির ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ওই বিদ্যালয়ের ছাত্ররা মঞ্চস্থ করে ঋত্বিকের বিপ্লব দে নির্দেশিত নাটক ‘চারণ গাঁথা’। ‘চারণ গাঁথা’ আসলে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতার নাট্যরূপ। গত এপ্রিলে গুধিয়া হাইস্কুলের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে সেই স্কুলের ছেলেরা রাজেন দাস নির্দেশিত নাটক ‘চিকৎসা’ মঞ্চস্থ করে। বহরমপুরের নাট্যসংস্থা ‘সুহৃদ’- এর কণর্ধার হরপ্রসাদ দাস বছর পাঁচেক ধরে খড়গ্রামের ইন্দ্রানী হাসনা-মায়ানি হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নাট্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তিনিই ফের ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ববরমপুরের চোঁয়াপুর বিদ্যানিকেতনের ছাত্রীদের অভিনয় শিখিয়েছেন। বহরমপুর শহরের এত জন নির্দেশক ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র মতো কাজে নিজেদের স্বেচ্ছায় নিয়োজিত করেছেন কেন? আসলে তাঁদের কাছে এই সব প্রকল্প ‘গুরু দক্ষিণাও বটে! কী রকম?
গাঙচিলের রাহুলদেব জানান, ১৯৯১-৯২ সালে বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটার ছোটদের নিয়ে একটা কর্মশালা করে। প্রশিক্ষক ছিলেন ‘ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামা’র নির্দেশক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী। সেখানের তাঁদের মতো শিক্ষানবীশরা মঞ্চস্থ করেছিলেন সুকুমার রায়ের ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। সন্দীপ বাগচি, শুভদীপ মুখোপাধ্যায় ও মাহাতাব চৌধুরীর মতো আজকের দিনের নাটক ও সিনেমা জগতের অনেক নির্দেশক ও অভিনেতার জন্ম ওই কর্মশালা থেকে। সেই কারণে তাঁরাও বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটার ও তার কর্ণধার প্রদীপ ভট্টাচার্যের কাছে ঋণী। তাঁর পথ অনুসরণ করেই স্কুল পড়ুয়াদের নিয়ে ৮ মাসের কর্মশালার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। রেপার্টরি থিয়েটারের প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘১৯৯২-৯৩ সালেও বহরমপুরের বেশ কয়েকটি স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়ে ৫টি নাট্যদল গড়া হয়। কর্মশালায় তাদের প্রশিক্ষণ দেন রাজ্যের ৫ জন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব। শিক্ষানবীশরা ৫টি নাটকও মঞ্চস্থ করেছিল।’’
ওই শহরের নাট্য আন্দোলনের আরও একটি চমকপ্রদ ইতিহাস তুলে ধরছেন প্রদীপবাবু। তিনি বলেন, ‘‘১৯৯৫ সাল। সন্দীপ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে গড়ে উঠল রঙ্গাশ্রম নাট্য বিদ্যালয়। আমিও ছিলাম তাঁর সঙ্গে। এক বছরের একটি কোর্সে নাট্যশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। চলেছিল ২ বছর।’’ এই শহরের নাট্য প্রশিক্ষণের ওই পরম্পরার অন্য একটি উজ্জ্বল ইতিহাসের কথা লিখেছেন ছান্দিকের কর্ণধার শক্তিনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বহরমপুরে নাটকের পথ চলা’ প্রবন্ধে। কাশিমবাজারের মহারানি স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর পর মহারাজা হলেন প্রয়াত নিঃসন্তান রাজা কৃষ্ণনাথের ভাগ্নে মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী।
শক্তিনাথবাবু লিখেছেন, ‘‘১৮৯৯ সালে কাশিমবাজারে তিনি (মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী) একটি নাট্য বিদ্যালয় স্থাপন করলেন— ‘দ্য কাশিমবাজার স্কুল অব ড্রামা’। গিরিশচন্দ্রের বাগবাজার দলের বিশিষ্ট অভিনেতা গোবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এলেন অধ্যক্ষ হিসাবে। সেই সময় গিরিশচন্দ্র তাঁর দলবল নিয়ে কাশিমবাজারে প্রায়ই অভিনয় করে যেতেন।’’ ফের কাশিমবাজারের অপেশাদার দল কলকাতায় নিয়ে যায় ‘রিজিয়া’ প্রযোজনাটি।
শক্তিনাথবাবু লিখেছেন, ‘‘শিক্ষানবীশিরা যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গে তাঁদের পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছিলেন কলকাতার গণ্যমান্য বিশিষ্ট শ্রোতা-দর্শকদের সামনে। ওই নাট্য বিদ্যালয় প্রায় পঁচিশ বছর চালু ছিল।’’
উল্লেখ্য, দ্য কাশিমবাজার স্কুল অব ড্রামা’র আগে ভূ-ভারতে কোনও নাট্য অ্যাকাডেমির খোঁজ পাওয়া যায় না। ওই ঐতিহ্যের পরম্পরার সরণি ধরে আজকের গাঙচিলের আট মাসের ‘থিয়েটর ইন এডুকেশন’ প্রকল্প, রেপার্টরির ‘বিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতা ও উৎসব’। ঋত্বিক, ছান্দিক, সুহৃদ, যুগাগ্নি- সহ বিভিন্ন দলের কর্মশালা ও নাট্যচর্চা।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর- নদিয়া মুর্শিদাবাদ’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান www.facebook.com/anandabazar.abp বা চিঠি পাঠান আমার শহর, নদিয়া-মুর্শিদাবাদ বিভাগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১