আজমাইল শাঁ। নিজস্ব চিত্র
বিশ্বকাপ ফুটবলের আনন্দ-উত্তেজনা ফাইনাল খেলার হাত ধরে এ বছরের মতো শেষ। কিন্তু যে ফুটবলের কোনও শেষ নেই, তা হল প্রতিদিনের ফুটবল।
এখন জমে উঠেছে সীমান্তের ফুটবল উৎসব। একদিকে চলছে আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত লিগ প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে, বিভিন্ন ক্লাবের উদ্যোগে এক দিনের ফুটবল টুর্নামেন্ট। একাধারে, এই ফুটবল উৎসব যেমন এলাকার খেলোয়াড়দের শরীরচর্চা এবং দর্শকদের বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাশাপাশি, মরসুমের এই খেলার উপর নির্ভর করে থাকে প্রত্যন্ত গাঁ-য়ের বেশ কিছু জন যুবকের রুজিরুটিও।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মুরুটিয়ার আজমাইল শাঁ ও রাজু সেখ, সোহেল সেখ, তারকগঞ্জের রিজু মণ্ডল, মুক্তাদহের চন্দ্রেশ্বর মণ্ডলের মতো প্রতিভাবান ফুটবলারেরা। নিতান্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারের এঁরা সকলেই বেকার। বছরভর কেউ মাঠে কাজ করেন, আবার, কেউ দিনমজুর। তাঁরা টাকার বিনিময়ে এই মরসুমের ক’টা দিন বিভিন্ন দলের হয়ে চুটিয়ে ফুটবল খেলেন।
বছর চব্বিশের আজমাইল শাঁ জানান, খুব ছোটবেলায় তাঁর বাবা-মা মারা গিয়েছেন। কাকা ও ঠাম্মার কাছে বড় হয়েছেন। বাড়ির সম্পত্তি বলতে কাকার সামান্য জমিটুকু। অভাবের কারণে নবম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করতে পেরেছেন আজমাইল। এবং জানাতে ভোলেন না, কাকা রসিদ শাঁ ফুটবল ভালবাসেন বলে ছোট থেকেই তিনিই উৎসাহ জুগিয়েছেন খেলায়— ‘‘কাকা আমায় মাঠে ফুটবল খেলতে নিয়ে যেতেন। এখন খেলার পাশাপাশি জমিতেও কাজ করতে হয়।’’
আজমাইল জানান, জুলাই মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলেন তিনি। কোনও একটি খেলার জন্য পান চারশো টাকা। কোথাও আবার দেড় হাজার টাকাও— ‘‘গত মরসুমে ফুটবল খেলে মোট ছত্রিশ হাজার টাকা আয় হয়েছিল। যা দিয়ে সংসার ও নিজের খরচ চালাতে পারছি।”
প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন বছর কুড়ির সোহেল শেখ। তাঁর কথায়, “আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনা করতে পারিনি। সংসার টানতে খুব ছোট থেকেই আমায় লড়াই করতে হয়েছে। বছরের প্রতিটা দিনই দিনমজুরের কাজ করি।’’ তবে তার ফাঁকে নিজের নেশা এবং ভাললাগার সঙ্গে আপস করেননি। ‘‘মরসুমের এই পাঁচ মাস কাজের ফাঁকে এলাকার বিভিন্ন দলের হয়ে ফুটবল ম্যাচ খেলে বেড়াই। প্রতি বছর লিগের পাশাপাশি এই সময়ে বহু জায়গায় প্রচুর ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়। সেখানকার প্রতিযোগিতায় খেলার জন্য অনেক দল থেকে ডাক আসে।’’
ম্যাচ খেলে বাড়তি যে রোজগারটুকুও হয়, সেটা জানাতে ভোলেননি— ‘‘এক-একটি ম্যাচ খেলে কোথাও চারশো, কোথাও সাতশো, কোথাও বারোশো টাকা রোজগার হয়।’’
সোহেলের অভিমান, এই খেলার জন্য আগে বাড়িতে প্রচুর বকাবকি খেতে হয়েছে। তখন পাড়ার বড়রা অনেকেই বাঁকা কথা বলতেন তাঁকে। তাঁরা বিষয়টি পছন্দ করতেন না। অনেকে খেলা ছেড়ে দিয়ে মাঠে চাষের কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সব বাধা অতিক্রম করে সোহেল পাখির চোখ করেন অনুশীলনকে— ‘‘প্রতিদিন কাজের ফাঁকে অনুশীলন করি। কারণ, এখন নিজের ক্লাবের সঙ্গে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলি। টাকা রোজগার করি।’’ আক্ষরিক অর্থেই ময়দান ছাড়েননি তিনি ‘‘সকলেই জেনে গিয়েছে, খেলা আমি ছাড়তে পারব না। আর এই খেলাই এখন আমাদের অন্ন জোগায়। এখন স্ত্রী ছাড়া আমায় আর কেউ কিছু বলে না।”
করিমপুর আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক সুজিত বিশ্বাস জানান, বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে খেলার মাঠে নতুন প্রজন্মের হাজিরা অনেক কম। তার মাঝেও রিজু, সোহেলদের মতো কয়েকজন খেলা-পাগল ছেলের জেদের কারণেই এলাকায় এখনও ফুটবল টিকে রয়েছে।
সাতান্ন বছর বয়সেও প্রতিদিন মাঠে খেলতে যান করিমপুরের প্রাক্তন খেলোয়াড় ও পেশায় স্কুল শিক্ষক কার্তিক পাল। তিনি বলেন, ‘‘এলাকায় এমন অনেক ভাল ফুটবল খেলোয়াড় আছেন, যাঁদের প্রতিভা থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে, অভাবের কারণেই এখানে অনেকে খেলা ছেড়েছে। আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা সে তুলনায় মাঠবিমুখ। তারা খেলার জন্য মাঠের বদলে মোবাইলকে বেছে নিয়েছে!’’
তাঁর আক্ষেপ, করিমপুর ও আশেপাশের এলাকায় ফুটবল কোচিংয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই। থাকলে হয়তো অনেকেই আরও বড় জায়গায় খেলার সুযোগ পেত।