বাধার পাহাড় উজিয়ে লড়াই ওদের

মাধ্যমিকে তার প্রাপ্ত নম্বর ৩৬৮। সন্তানের এমন সাফল্যে চোখের জল বাধা মানছে না দুই কৃতীর বাবা-মায়েদের।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৮ ০২:২০
Share:

লিপিকা মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র।

বাধা তো ছিলই। সেই বাধা টপকাল ওরা। আর তা করতে পেরে তাদের ঠোঁটের কোণে জমা হয়েছে চিলতে হাসি। সংসারে টানাটানি ছিল। কিন্তু তার চেয়ে বড় বাধা ছিল শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। পেশায় খেতমজুরের ছেলে রবিউল ইসলামের হাত-পা অসাড়। একা চলাফেরা করতে পারে না। সেই ছেলে মাধ্যমিকে পেয়েছে ৪২২ নম্বর। অন্য দিকে, আজন্ম দৃষ্টিহীন লিপিকা মণ্ডল। স্কুলের আবাসনে থেকে চলত তার পড়াশোনা। মাধ্যমিকে তার প্রাপ্ত নম্বর ৩৬৮। সন্তানের এমন সাফল্যে চোখের জল বাধা মানছে না দুই কৃতীর বাবা-মায়েদের।

Advertisement

রবিউল পাঁচ বছর বয়স পর্যন্তও হেঁটে-চলে বেড়িয়েছে। হঠাৎ সে জ্বরে পড়ে। প্রথম তাকে ডোমকলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে বহরমপুরে জেলা হাসপাতালে ও পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। তাতে জ্বর ছাড়ল বটে, কিন্তু রবিউল হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এখন রবিউল ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী।

একা একা চলাফেরা করতে না-পারায় মা-বাবা কোলে করে স্কুলে তাকে পৌঁছে দিত। আবার তাঁরাই স্কুল থেকে ছেলেকে ফিরিয়ে আনতেন। স্কুলের পাশে বাড়ি হওয়ায় কখনও কখনও রবিউলের বন্ধুরাও বাড়ি থেকে তাকে স্কুলে নিয়ে যেত। এমন প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে মাধ্যমিকে ৬০ শতাংশের ওপরে নম্বর পেয়ে ডোমকলের শিবনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে সে। রবিউল পাশ করায় খুশি গ্রামের লোকজনও।

Advertisement

মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছেন রবিউলের মা নাসরিন বানু বিবি। তিনি এখন শিবনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিলের রাঁধুনির কাজ করেন। মাধ্যমিক পাশ মহম্মদ লুতফর অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে রবিউল বড়।

লুফতর বলছেন, “ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা। আবার ছেলে নিজে হাঁটাচলা করতে পারে না। সে কারণে ওকে টিউশন নেওয়ার জন্য পাঠাতে পারিনি। যা পড়াশোনা বাড়িতেই করত।’’ নিজেরাও ছেলেকে নিয়ে বসতেন। রবিউল জানাচ্ছে, “ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে আছে। কলা বিভাগ নিয়ে শিবনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাই।” কিন্তু সেই স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংসারের অনটন। রবিউলের মা বলছেন, ‘‘ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় আছি। এখন ওর উঁচু ক্লাসের পড়াশোনার খরচ কোথা থেকে পাব, সেই চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে।’’

বুধবার মাধ্যমিকের ফল বেরনোর পরে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তার পুরনো স্কুলের শিক্ষকেরাও। কৃষ্ণনগরের মৃণালিনী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী লিপিকা মণ্ডল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হেলেন কেলার স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে পড়শোনা করেছে। সেখানেই থাকত। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয় মৃণালিনী বালিকা বিদ্যালয়ে। আর পাঁচটা সাধারণ পড়ুয়ার সঙ্গেই পড়াশুনো করেছে। পড়াশোনা চলত পুরনো স্কুলের হস্টেলে থেকে। ব্রেইল নির্ভর ছিল তার পড়াশোনা। হেলেন কেলার স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের অধ্যক্ষ স্বপন সরকার বলছেন, “আমরা ওর জন্য প্রতি মুহূর্তে গর্ব বোধ করছি।”

লিপিকার বাড়ি নাকাশিপাড়ার বিল্বগ্রামে। বাবার দৃষ্টি ক্ষীণ। দিদিও দৃষ্টিহীন। বাড়িতে ছোট্ট মুদির দোকান আছে। সংসার চালাতে সেই দোকানই ভরসা। লিপিকা বলছে, ‘‘স্যারেদের জন্য এতদূর আসতে পেরেছি। তাঁদের অবদান কোনও দিন ভুলব না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন