মলিন ঘরে হাজার ওয়াটের আলো

শুধু গৃহশিক্ষক নয়। গোপালের নেই এর তালিকা দীর্ঘ। বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, পেট ভরে দু’বেলা খাওয়াও তার কাছে প্রায় নেই-এর মতোই দুর্লভ।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও সামসুদ্দিন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৮ ০০:৫৩
Share:

অপর্ণা কোনাই, সৌমাল্য বক্সী ও গোপাল বসাক

বাড়ির উঠোনে বসে জৈব যৌগ নিয়ে অনর্গল কথা বলছিল ঝকঝকে চোখের ছেলেটি। বাড়ি মানে, খানকয়েক টিন দিয়ে তিন দিক ঘেরা একটা খুপড়ি। তারই ছ্যাতলা ধরা উঠোনে বসে কথা হচ্ছিল গোপাল বসাকের সঙ্গে। নবদ্বীপ আর সি বি সারস্বত মন্দির স্কুল থেকে ৫৩৭ পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে কোনও গৃহশিক্ষক ছাড়াই!

Advertisement

শুধু গৃহশিক্ষক নয়। গোপালের নেই এর তালিকা দীর্ঘ। বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, পেট ভরে দু’বেলা খাওয়াও তার কাছে প্রায় নেই-এর মতোই দুর্লভ।

সপ্তাহে সাত দিন নিয়ম করে পড়ার উপায় পর্যন্ত নেই। বৃহস্পতি, শুক্র আর রবিবার গোপালের পড়া বন্ধ। ওই তিন দিন নবদ্বীপে হাট বসে। অসুস্থ বাবার সঙ্গে হাটে থাকতে হত বড় একটা সময়। এমনকি মাধ্যমিকে ইতিহাস পরীক্ষার আগের দিনও সারা দিন হাটেই কেটেছিল তার। সামান্য কয়েকখানি গামছা মহাজনের কাছ থেকে নিয়ে হাটে বসেন গোপালের বাবা বলাই বসাক। চরম দারিদ্র্যে গোপালের ভরসা ছিল পনেরো দিন অন্তর মাথাপিছু পাঁচশো গ্রাম করে রেশনের চাল। এই অবস্থায় গৃহশিক্ষক বলতে এলাকার দিবাকর সেন ছোট থেকে নিখরচায় পড়িয়েছেন তাকে। বাকিটা স্কুলের শিক্ষকেরা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিজনকুমার সাহা বলেন, “গোপালের ফলে আমরা খুব আশাবাদী। উচ্চমাধ্যমিকে স্কুল ওর পাশে আছে। আমরা চাই ও শুধুই পড়ুক।”

Advertisement

টাকার অভাবে ছেলেকে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন সারদায় সর্বস্বান্ত বাবা। ভর্তি করেছিলেন নবদ্বীপ বকুলতলা হাইস্কুলে। শুরু হয়েছিল অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ। পাঁচ বছর পর সেই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত সফল সৌমাল্য বক্সী। মাধ্যমিকে ৬৬৮ নম্বর পেয়ে নবদ্বীপে প্রথম হয়েছে নবদ্বীপ বকুলতলা হাইস্কুলের মুখচোরা ছেলেটি। বিরাট কোহলির অন্ধ ভক্ত সৌমাল্য টেস্টে ফোর্থ হয়েছিল। পরের কটা সপ্তাহের প্রস্তুতি যেন স্লগ ওভারের ব্যাটিং। যার নিট ফল টেস্টের থেকে ৩৪ নম্বর বাড়িয়ে মাধ্যমিকে বাজিমাত।

একসময় নবদ্বীপের প্রতিষ্ঠিত প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের মালিক বাবা শ্যামল বক্সীর অকপটে বলেন, “সারদা করতে গিয়ে সব দিক থেকেই শেষ হয়ে গিয়েছি। পুঁজি নিঃশেষ। দুবেলা খাওয়ার সংস্থান নেই। ছেলেকে বাধ্য হয়ে মিশন থেকে নিয়ে আসতে হল। শেষমেশ সংসার চালাতে টোটো নিয়ে পথে নামতে হয়েছে।” বকুলতলা হাইস্কুলের পিছনেই বাদুড়তলার তস্য গলির মধ্যে ছোট্ট বাড়ির বারান্দায় বসে সৌমাল্যর মা বলেন, “এইট পর্যন্ত আর্টসটা আমি পড়াতাম। নাইনের পর গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা। ওর বাবার আর্থিক অবস্থার কথা জেনে স্কুল এবং শিক্ষকেরা নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাতেই এই সাফল্য।”

মার্কশিটটা হাতে নিয়ে কেবলই মায়ের কথা মনে পড়ছে অপর্ণা কোনাইয়ের। তার জন্মের পরেই বাবার সঙ্গে মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। বহরমপুরের সুতির মাঠে মামারবাড়িতে মায়ের কাছেই বড় হচ্ছিল অপর্ণা। স্থানীয় চুয়াপুর বিদ্যানিকেতন গার্লস হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পরেই মা ও মারা যান। পরের কটা বছর চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও লেখাপড়া করে মাধ্যমিকে ৪৪৮ নম্বর পেয়েছে অপর্ণা। স্কুলের শিক্ষিকাদের কথায় যে পরিস্থিতিতে অপর্ণা লেখাপড়া করেছে তাতে এই ফল অভাবনীয়।

ইতিমধ্যে চুয়াপুর বিদ্যানিকেতন গার্লস হাইস্কুলে আর্টস নিয়ে ভর্তি হয়েছে অপর্ণা। বলছে, “স্কুলের দিদিদের সাহায্য ছাড়া আমার পড়াশুনো হতো না। আমার মামা অসুস্থ। যদি ওঁকে একটু সাহায্য করতে পারতাম ভাল লাগত।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন