টোটোচালক ইমরানের মা, বাবা ও বোনেরা। নিজস্ব চিত্র
পুতুলখেলা বন্ধ! টাকমাথা মেয়েপুতুলটাকে দু’হাতে আঁকড়ে খাটের পাশে থম মেরে বসে রয়েছে রেক্সোনা। কথা বলছে না সকাল থেকে। অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে খাওয়াতে পারেননি মা।
এই পুতুলটাই সবচেয়ে প্রিয় ছিল ঝর্ণার। তার মাথায় সুতো দিয়ে চুল তৈরি করে দেওয়ার জন্য প্রায়ই আবদার করত পাশের বাড়ির মামণি দিদির কাছে। তবে চুল নেই বলে খেলতে কোনও অসুবিধা হত না ঝর্ণা আর রেক্সোনার। দুই খুড়তুতো বোন। পুতুল খেলার সঙ্গী। শনিবার সকালেই রেক্সোনা জেনে গিয়েছে, ঝর্ণা আর আসবে না পুতুল খেলতে। চাপড়ার বানিয়াখড়ি গ্রামে জলসা দেখতে যাওয়ার সময় টোটো-দুর্ঘটনায় নিথর হয়ে গিয়েছে সে।
বছর আটেকের ঝর্ণা ছাড়াও শুক্রবারের ওই দুর্ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছেন একই গ্রামের মোট ছয় জন। মৃতদের মধ্যে একই পরিবারের চার জন রয়েছে। তালুহুদা গ্রাম তার পর থেকে কার্যত বাক্যহারা। চারদিকে অদ্ভুত এক স্তব্ধতা। দুর্ঘটনার কথা জানতে চাইলেই চোখের জল বাঁধ মানছে না কারও।
ঘটনার কথা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না মামণি। ঝর্ণা অসম্ভব ন্যাওটা ছিল তার। শুক্রবার জলসায় যাওয়ার আগে তার কাছে গিয়েই আবদার করে লাল লিপস্টিক পরেছিল ঝর্ণা। বলতে বলতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সে।
শোকের গ্রামে কারও বাড়িতেই এ দিন হাঁড়ি চড়েনি। হাতে-হাতে মোবাইলে ঘুরছে দুর্ঘটনায় দুমড়ে যাওয়া টোটো আর মৃতদেহগুলির ছবি। গ্রামের মুখের হুদা বিদ্যাপিঠ। এখানকারই ছাত্রী ছিল নাসরিন, তসলিমা। বছর চোদ্দোর তসলিমা আর বারো বছরের নাসরিন— দু’জনেই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। স্কুল ছুটি দেওয়া হয়েছে। কখন দেহ এসে পৌঁছোবে তা নিয়ে শুরু হয়েছে তারই প্রতীক্ষা।
হাঁটরা ও ছোট আন্দুলিয়ার মাঝামাঝি এলাকায় দুর্ঘটনাটি ঘটে শুক্রবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ। করিমপুর থেকে কৃষ্ণনগরগামী একটি লরি প্রচণ্ড গতিতে এসে টোটোটিকে ধাক্কা মারে। মৃতদের মধ্যে টোটোচালক ইমরানও রয়েছেন। তাঁর বাবা গত বছর থেকে দুর্ঘটনায় পঙ্গু। মাস ছ’য়েক হল টোটো কিনে সংসারের হাল ধরেন ইমরান। বাড়িতে অবিবাহিত বোন, মা রয়েছেন।
সব থেকে ভয়ঙ্কর অবস্থা চাবলু বিশ্বাসের। মর্গের ভিতরে পর-পর শুইয়ে রাখা তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বিশ্বাস, তিন মেয়ে তাসলিমা, নাসরিন আর ঝর্ণার দেহ। জখম চাবলু শুধু বুকফাটা বিলাপ করছেন। সামনে বসে বাবা-র দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে বছর দশেকের ছেলে বকুল।