চলছে জমি দখল। সোমবার কল্যাণীতে। নিজস্ব চিত্র
সরকারি ইটভাটার জমি দখল করে নিচ্ছেন শয়ে-শয়ে মানুষ! তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন সিমেন্টের ছোট পিলার, কাঠের খুঁটি, দড়ি। ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি করে যে যতখানি জমিতে পারছেন খুঁটি বা পিলার বসিয়ে দড়ি দিয়ে চার দিক ঘিরে নিচ্ছেন! সোমবার সকালে এমন অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী থাকল কল্যাণী শহর।
যদিও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শেষপর্যন্ত দখলকারীদের সরিয়ে দেয় কিন্তু তার আগে শাসকদলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে জমি দখলকারীদের একপ্রস্থ ধুন্ধুমার হয়ে গিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা প্রশাসনিক কর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। পুরসভা এবং শাসক দলের নেতারাও কী ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ, ঘটনার অনুঘটক হিসাবে তাঁদের অনেকেরই নাম সামনে এসেছে। অভিযোগ উঠছে, শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের একাংশ অনেক দিন ধরে টাকা নিয়ে ওই সরকারি জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রশাসন সব দেখেও নিশ্চুপ। তার জেরেই এ দিনের জমি দখল। তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব অবশ্য একে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
কল্যাণীর একেবারে শেষপ্রান্তে পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝেরচড়ে পুরনো সরকারি ইটভাটার শতাধিক বিঘা জমি অব্যবহৃত হয়ে পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, কল্যাণী শহর তৈরির সময় এই ইটভাটা করে সরকার। বিভিন্ন সরকারি দফতর গড়ার ইট সেখান থেকে নেওয়া হত। অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) নারায়ণ বিশ্বাসের কথায়, ‘‘কল্যাণী উপনগরী ঠিক যতটা বড় করার পরিকল্পনা ছিল এবং সেখানে যতটা শিল্পবিস্তারের কথা ভাবা হয়েছিল আখেরে তা হয়নি। ফলে ইটভাটা-সংলগ্ন বিপুল জমি অব্যবহৃত থেকে যায়।’’
কিন্তু আচমকা সেই জমি কেন দখল করতে যাবেন কয়েক শো মানুষ?
দখলকারীরাই দাবি করেছেন, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে তাঁদের। দিনের পর দিন তাঁরা চোখের সামনে দেখছেন, শাসক দলের কিছু স্থানীয় নেতা টাকার বিনিময়ে সরকারি জমি বেপাড়ার লোকেদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাঁরা এসে দিব্যি জমি দখল করে বসে ঘরবাড়ি বানিয়ে নিচ্ছেন। অথচ তাঁরা এলাকার লোক হয়ে জমি পাচ্ছেন না। রবিবারও কিছু লোক জমি দেখতে এসেছিলেন বলে দাবি করেছেন তাঁরা। তার পরেই তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং সোমবার সকালে একেবারে পিলার পুঁতে, দড়ি লাগিয়ে জমি দখল করেন। শাসক দলের নেতা ও পুরকর্তারা ঘটনাস্থলে এলে তাঁদের মুখের সামনেই দখলকারীরা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘‘এখানে তৃণমূল নেতারা নেতারা টাকা পাচ্ছেন না বলে আমাদের হঠিয়ে দেওয়া হল। টাকা দিলে আমাদেরই বসানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হত।’’
এ দিন দুপুরে ঘটনার কথা জানতে পেরে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর ভক্তিভূষন রায়, কল্যাণী ব্লক তৃণমূলের সভাপতি তপন মণ্ডল ও পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মনোজ বিশ্বাস। ভক্তিবাবু মাঠে নেমে পড়ে পিলার তুলতে শুরু করেন আর দড়িগুলি পোড়ানোর নির্দেশ দেন। তাতেই তুলকালাম শুরু হয়। তাঁদের সামনেই লোকজন বলতে থাকেন, ‘‘স্যার আমাদের জমি দখল করতে দিচ্ছেন না। আর ওই দেখুন আপনাদের নেতারা টাকা নিয়ে লোক বসিয়েছেন। জমিতে ঘর তৈরি করেছেন। আমাদের পিলার ভাঙতে হলে ওদের ঘরও ভাঙতে হবে।’’ শুরু হয় বচসা, হাতাহাতি। তা সামলাতে তপন মণ্ডলকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। প্রায় আধঘণ্টা এই রকম চলে। পরে কল্যাণী থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী গিয়ে লোকজনকে বুঝিয়ে পিলার তুলে দেয়। কিন্তু কিছু ক্ষণ পর ফের জমি দখল শুরু হয়। বাড়ির মহিলাও জমি দখলে সামিল হন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ বেলা সাড়ে চারটে নাগাদ জমি খালি করতে পারেন।
ভক্তিবাবু গোটা ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘সরকারি জমির দখল পাওয়া যাচ্ছে এমন গুজব কেউ ছড়াচ্ছে।’’ ভক্তিবাবু বলছেন, সরকারি জমির দখল পাওয়া যাচ্ছে, এই গুজব কেউ ছড়িয়েছে। তাতেই এমনটা হল। আর শহর তৃণমূলের সভাপতি অরূপ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘দলের কেউ যদি ইতিপূর্বে জমি বেচে তাহলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ করব। আর ওই জমিতে বাড়ি হলে তা প্রশাসনের সহায়তায় ভেঙে দেব।’’ তিনি জানান, ওই জমিতে সরকারি আবাসন প্রকল্প হবে। পুরসভার সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্ট হবে। বিজেপির দিকে ইঙ্গিত করে তাঁর বক্তব্য, ‘‘এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক দলের ইন্ধন রয়েছে।’’ আর বিজেপির স্থানীয় নেতা কৃষ্ণ মাহাতো বলছেন, ‘‘ওই জমি দখল হচ্ছে এই মর্মেও বহু বার প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি। এ দিন যা হয়েছে, তা বঞ্চিত মানুষের স্বতস্ফূর্ত ক্ষোভের প্রকাশ।’’ এ দিন জমি দখলকারীরা শাসক দলের নেতা ও পুরকর্তাদের কিছু লিখিত নথি দেখিয়ে অভিযোগ করেন, অতিরিক্ত জেলাশাসকের (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) নারায়ণ বিশ্বাসের অনুমতিতে রয়্যালটি নিয়ে মাটি কাটা চলছে। সেই মাটি চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। নারায়ণবাবু জবাব, ‘‘অনুমতি দিয়েছি কিনা ঠিক মনে করতে পারছি না।’’