বন্ধ অন্তর্বিভাগ, বেহাল রাস্তা পেরিয়ে শহরে ছোটেন প্রসূতি

এক সময় গমগম করত সেগুলি। দূর দূর গাঁ থেকে একটু চিকিৎসা পেতে ছুটে আসতেন মানুষগুলো। রাত-বিরেতে ব্যামো হলে, প্রসূতির গর্ভযন্ত্রণা উঠলে বড় ভরসার জায়গা ছিল সেগুলি। তারপর দিন দিয়েছে। জরা এসেছে। কোনওটিতে লোকাভাবে তালা পড়েছে। কোনওটিকে টিকে থাকলেও অবস্থা সঙ্গিন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৬ ০০:০৪
Share:

লোপাট হয়ে গিয়েছে জানালা। সমরেসগঞ্জের পুঁটিমারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। — নিজস্ব চিত্র।

এক সময় গমগম করত সেগুলি। দূর দূর গাঁ থেকে একটু চিকিৎসা পেতে ছুটে আসতেন মানুষগুলো। রাত-বিরেতে ব্যামো হলে, প্রসূতির গর্ভযন্ত্রণা উঠলে বড় ভরসার জায়গা ছিল সেগুলি। তারপর দিন দিয়েছে। জরা এসেছে। কোনওটিতে লোকাভাবে তালা পড়েছে। কোনওটিকে টিকে থাকলেও অবস্থা সঙ্গিন।

Advertisement

মুর্শিদাবাদ জেলায় মোট ৬৫টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু কোনওটিতে পুরোপুরি চিকিৎসা পরিষেবা পাচ্ছেন না স্থানীয়েরা। প্রায় সব ক’টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরই অন্তর্বিভাগ তালা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। কোনওটি ১৫ বছর ধরে। কোনওটি বা ২০ বছর। অথচ এক সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি অন্তর্বিভাগ চলত কোনওটি ১০ শয্যা নিয়ে, কোনওটি ৫ শয্যা। ২৪ ঘণ্টার জন্য চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকায় চিকিৎসা পরিষেবা পেতেন গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা।

সুতি ১ ব্লকের বহুতালি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এক সময় ১০ শয্যার অন্তর্বিভাগ চালু ছিল। পড়শি জেলা বীরভূম থেকেও লোকে চিকিৎসার জন্য আসতেন। তারপর ধীরে ধীরে চিকিৎসক, নার্সের অভাবে তালা পড়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ২০১০ সালে প্রায় সাড়ে ষাট লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালুর জন্য। বহুতালির বাসিন্দা ও প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান শিমূল রবিদাস জানান, বরাদ্দ অর্থ ছয় বছর ধরে পড়ে আছে। একটা ঘরে কোনও রকমে চলছে বহির্বিভাগ। গ্রামেরই বাসিন্দা এক ফার্মাসিস্ট। এক চিকিৎসক মাঝে মধ্যে আসেন। তাই চিকিৎসা বলতে ১৭ কিলোমিটার দূরে আহিরণের ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

Advertisement

একই অবস্থা সুতি ১ ব্লকের হিলোড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরও। নতুন ঘর, বিদ্যুৎ, জলের পাম্প সব রয়েছে। একজন চিকিৎসকও রাতে থাকেন। অন্যরা যাতায়াত করেন।

এলাকার বাসিন্দা প্রাক্তন বিধায়ক জানে আলম মিঞা বলেন, “আগে ১০ শয্যার স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল। এখানে একসময় চিকিৎসক ছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্য অধিকর্তা কৃষ্ণচন্দ্র বারুই। তিনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকে এমন ভাবে গড়ে তোলেন যে আশপাশের অন্তত ৪০টি গ্রামের রোগীরা ভর্তি হতে আসতেন এখানে।’’ এখন ঘর থেকেও স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু না হওয়ায় কোনও পরিষেবাই পাচ্ছেন না গ্রামবাসীরা। বেহাল রাস্তা পেরিয়ে শহরে ছুটতে হচ্ছে প্রসূতি মায়েদের।

সাগরদিঘির সিংহেশ্বরী গৌরীপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির ভবন সম্পূর্ণ হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। জল, বিদ্যুৎ সব এসেছে। গত বছর ১৬ ডিসেম্বর সাগরদিঘিতে এসে মুখ্যমন্ত্রী তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও করেন। কিন্তু বন্ধ হয়ে থাকা ১০ শয্যার স্বাস্থ্য কেন্দ্র আজও চালু হয়নি। চলছে বলতে দু’ঘণ্টার বহির্বিভাগ। এলাকার তৃণমূল নেতা মোদাশ্বর হোসেন বলেন, ‘‘তাই ১৫ কিলোমিটার দূরের সাগরদিঘি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রই ভরসা প্রসূতি মায়েদেরও।”

সাগরদিঘিরই মণিগ্রাম ও সূর্যপুর দু’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রই বন্ধ দু’দশক ধরে। দুটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রই একসময় ১০ শয্যা চালু ছিল। মণিগ্রামের উত্তম ঘোষ বলছেন, “এই এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে কিছু নেই। বহুবার দাবি জানিয়েছি অন্তর্বিভাগ চালুর। কিছু হয়নি। বহির্বিভাগ চলে, না চলার মতোই। চিকিৎসক আগে আসত। এখন তাও বন্ধ।

সূর্যপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র লাগোয়া গাঙাড্ডা গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি উত্তম মুখোপাধ্যায় বলেন, “পরিকাঠামো এখনও আছে। একদিন এখানে হোমিওপ্যাথ, অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসক-সহ ১০ শয্যার স্বাস্থ্যকেন্দ্র রমরমিয়ে চলত। এখন সব বন্ধ।’’ এখন সোম, বুধ ও শুক্রবার বহির্বিভাগ চলে।

একই অবস্থা রঘুনাথগঞ্জের বাড়ালা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির। এককালে ১০ শয্যার অন্তর্বিভাগ চালু ছিল। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাকাতি হওয়ার পর বছর পাঁচিশ আগে বন্ধ হয়ে যায় অন্তর্বিভাগ। নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ৭ বছর আগে। এখনও সে ভবন তৈরির কাজই শেষ হয়নি। এখন এক বেলার আউটডোর চলছে।

সমশেরগঞ্জের পুটিমারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবস্থা আরও খারাপ। ১০ শয্যার ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য তৈরি ঘর ভেঙেচুরে বেহাল। জানালা, দরজা সব লোপাট। একটা ঘর কোনও রকমে সারিয়ে সেখানে বহির্বিভাগ চালাচ্ছেন এক জিএনএম নার্স ও এক স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁরা জানান, জনা ৩৫ রোগী হয় রোজ বহির্বিভাগে। গত একবছরে ৪০ জন যক্ষা রোগীর খোঁজ মিলেছে এখানে।

পরিত্যক্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশেই বাড়ি সমশেরগঞ্জের তৃণমুল বিধায়ক আমিরুল ইসলামের। তিনি বলছেন, “দোগাছি, ভাসাই পাইকর এলাকার অন্তত ৩০টি গ্রামের জন্য পুটিমারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি একমাত্র ভরসা। কিন্তু চোখের সামনে গোটা ভবনটাই শেষ হয়ে গেল।’’ একই অবস্থা জলঙ্গির ফরিদপুর, হরিহরপাড়ার চোয়া, উত্তর মহম্মদপুর, চৈতন্যপুর সহ ৬৫টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরও।

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভাশিস সাহা বলেন, “জেলায় ৬৫টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ নেই। ১২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংস্কার ও পরিবর্ধনের কাজ চলছে। জেলা পরিষদ সে কাজ করছে। হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত সেগুলিতে অন্তর্বিভাগ চালু করা যাচ্ছে না। তবে চৈতন্যপুর, চন্দনপুর, ও উত্তর মহম্মদপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তিনটি খুব শীঘ্রই চালু হচ্ছে।’’ জেলা পরিষদের সভাধিপতি শিলাদিত্য হালদার জানান, আগের জেলা পরিষদের আমলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি তৈরির কাজ শুরু হয়। আগে সে কাজ দেখাশুনোর ভার ছিল ব্লকের ওভারসিয়ারদের উপর। এখন তাঁরা তা দেখছেন না। তিনি নিজে এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতরকে একটি বৈঠক ডাকতে বলেছেন। তাঁর মতে, ৬৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ চালু হলে মহকুমা ও জেলা হাসপাতালগুলির উপর চাপ অনেকটাই কমে। খুব শিঘ্রই এ নিয়ে স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে বসবেন যাতে সেগুলির কাজ দ্রুত শেষ করে অন্তর্বিভাগ চালু করা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন