সেই সব নিথর দেহ।
মেয়েটার বয়স ছিল মোটে কুড়ি।
সদ্য মা হয়েছে সে। বর গিয়েছিল মিছিলে পা মেলাতে। আর ফিরল না।
চব্বিশ বছর পরে সেই মেয়ে, হরিহরপাড়ার কল্যাণী দত্ত বলছেন, ‘‘সংসার কাকে বলে, তা-ই তখন ঠিক করে বুঝিনি। সেই সময়ে ও চলে গেল। সন্তান মানুষ কী ভাবে করেছি আমিই জানি।’’
১৯৯২ সালের ২ নভেম্বর।
আগে থেকেই ঠিক হয়েছিল, সে দিন বড় মিছিল নিয়ে হরিহরপাড়া ব্লক অফিসে গিয়ে আইন অমান্য হবে, চলতে থাকা দুষ্কৃতীরাজের প্রতিবাদ হিসেবে। নেতৃত্বে সিপিএম (তখনকার শাসকদল) ছাড়া বাকি সব দলের লোকেদের নিয়ে গড়া শান্তি কমিটি।
উদ্যোগটা জরুরি ছিল।
এমনিতে ওই এলাকায় কখনও কংগ্রেস, কখনও এসইউসি, কখনও সিপিএম ভোটে জিতেছে। কিন্তু ১৯৮৫-র মাঝামাঝি থেকেই এলাকা অশান্ত হতে শুরু করেছিল। দিনে-দুপুরে খুন, রাহাজানি, অপহরণ হতে থাকে আকছার। রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে দাপিয়ে প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে দুষ্কৃতীরা। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকে।
এই পরিস্থিতিতেই ১৯৯২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় প্রভাত সঙ্ঘের মাঠে এলাকার নানা শ্রেণির মানুষ একত্রিত হয়ে হরিহরপাড়া নাগরিক কল্যাণ পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। মূল উদ্যোক্তাদের দাবি, সিপিএমকে চিঠি দিয়ে ডাকা হলেও তারা আসেনি। কল্যাণ পরিষদ ঠিক করে, ২ নভেম্বর ব্লক অফিসের সামনে গণ আইন অমান্য কর্মসূচি পালন করা হবে।
বছর সাঁইত্রিশের বকুল মণ্ডলের মনে পড়ে, হরিহরপাড়া মোড়ে বাঁ দিকে ছিল হনুমান ক্লথ স্টোর (এখন সেখানে গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষা হয়)। তার সামনে কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত। চলছিল বক্তৃতা। ‘‘সে দিন সোমবার। আমি তখন ক্লাস নাইনে। স্কুলে গিয়ে দেখি, বড় জমায়েত আছে বলে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি আর আমার বন্ধু বিকাশ বাড়ি ফিরছি হরিহরপাড়া মোড় হয়ে। জানি, বাবা-কাকারা জমায়েতে রয়েছেন। দুপুর ১টা নাগাদ দেখি, বহরমপুরের রাস্তা দিয়ে বড় বড় জাল লাগানো পুলিশ ভ্যান এসে পৌঁছচ্ছে।’’
শুধু পুলিশ নয়, ইএফআর-ও ছিল সঙ্গে। হরিহরপাড়া মোড় থেকে তিনশো মিটার মতো দূরে ব্লক অফিস চত্বরে তারা জড়ো হতে থাকে। বেলা আড়াইটের পরে শুরু হয় মিছিল। হাতে-হাতে পোস্টার, গলায় স্লোগান। পরিষদের নেতাদের মতে, ছ’সাত হাজার মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল সচরাচর দেখা যায় না।
কল্যাণ পরিষদের অন্যতম মুখ্য উপদেষ্টা (এখন বয়স বছর সত্তর) মদন সরকার ফিরিয়ে আনেন দিনটাকে: ‘‘আমরা ছিলাম একেবারে সামনে। আমার সঙ্গে কংগ্রেস বিধায়ক শেখ ইমাজউদ্দিন, স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক সত্যপদ ঘোষ, নিয়ামত হোসেন, গিয়াসউদ্দিন মণ্ডল, তোজাম্মেল হোসেন, মুকুল ঘোষেরা। প্রশাসন বলেছিল, মোড় পেরিয়ে হরিহরপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত ভবনের কাছে ব্যারিকেড থাকবে। কিন্তু তা ছিল না। আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। প্রথমে আমরা শ’তিনেক লোক। তার পরে বড় মহিলা বাহিনী।’’
মিছিল এগিয়ে ডান দিকে বাঁক নিতেই দেখা গেল, ব্লক অফিস প্রাঙ্গণে জেলার প্রায় সব থানা থেকে প্রচুর পুলিশ এনে জমা করা হয়েছে। সামনের তিনশো জন দফতর প্রাঙ্গণে পৌঁছতেই মিছিল আটকে দেওয়া হল। এক দিকে পুলিশের ব্যারিকেড, অন্য দিকে বন্দুকধারী পুলিশ। বেলা ৩টে পেরিয়েছে। মোরাম রাস্তার দু’দিকে প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে। রাস্তার পাশে সাইদুল শেখ ও আলাইহিম শেখের বাড়ি, আরও আশপাশের বাড়ির ছাদে তিলধারণের জায়গা নেই।
তখনও স্লোগান উঠছে। পায়ে পায়ে রাঙা ধুলো উড়ছে। নভেম্বরেও ঘামে ভিজছে শার্ট। চিৎকার, বিভ্রান্তি, ঠেলাঠেলি। হঠাৎই ভিড় থেকে একটা আধলা উড়ে গিয়ে লাগল ইএফআর জওয়ানের গায়ে। আর মওকা পেয়ে গেল পুলিশ। পরিষদের আর এক নেতা নিয়ামত হোসেন বলেন, ‘‘আমরা পুলিশের ব্যারিকেড পার হওয়ার চেষ্টা করছি। পাশে বাঁশের বেড়াটা তখনও অক্ষত। তার মধ্যেই শুরু হয়ে গেল লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস। গুলি ছুটে এল।’’ যারা মিছিলের সামনে ছিল, গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল তাদের কয়েক জন। ব্লক অফিসের সামনে কৃষ্ণচুড়া গাছের নীচে রক্তে ভিজে হয়ে উঠল ধুলো, থকথকে কাদা হয়ে গেল। উল্টো দিক থেকে উড়ে আসতে লাগল ইট-পাথর। কিন্তু তাতে কি গুলির মোকাবিলা করা যায়? চার জন ঘটনাস্থলেই নিহত। পরে বহরমপুরে হাসপাতালে মারা যান আরও তিন জন। এলোপাথাড়ি গুলিতে পাশের ছাদ ও রাস্তায় থাকা আরও কিছু মানুষ জখম হন।
হরিহরপাড়া চোঁয়া থেকে আসা সচ্চিদানন্দ পালের তখন বয়স ছিল বছর পঁয়তাল্লিশ। তাঁর স্ত্রী, বছর সাতষট্টির জ্যোতিলক্ষ্মী পাল বলেন, ‘‘ওঁর মৃত্যুর খবর শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি প্রথমে। লোকটা খেয়ে-দেয়ে মিছিলে গেল। মরে গেল! তখনকার যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় আমাদের বাড়ি এসে ১০ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। পরে বাম সরকার ২৫ হাজার টাকা নগদ দেয়।’’
কল্যাণীর শ্বশুর সুধীর দত্ত ছিলেন পুলিশ। কিন্তু তা বলে তাঁর স্বামী, বছর পঁয়তিরিশের শঙ্কর দত্ত রেহাই পাননি। পরে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করে। ‘দাস কমিশন’ গঠন করা হয়। মদনবাবুর দাবি, ‘‘সরকার আমাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। আগামী ১৬ নভেম্বর থেকে বহরমপুর আদালতে তার বিচার শুরু হতে চলেছে।’’
আর, ঠিক সেই সময়েই পঁচিশ বছরে পা দেওয়া সেই মৃত্যুমিছিলকে ঘিরে নানা কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কল্যাণ পরিষদ।
এখন স্মৃতি বলতে দু’টি ফলক রয়েছে। প্রতি বছর এই দিন টি স্মরণ করেন প্রবীণেরা। যদিও নবীন প্রজন্মের কাছে এই গল্প অনেকটাই অজানা। এ বার তাদের কাছেও পৌঁছে যেতে চাইছে কল্যাণ পরিষদ। কর্মসূচি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বছর জুড়ে।
আইনের লড়াই আছে ঠিকই। তার বাইরে অমান্যও রয়েছে যে!