সাতসকালে ভিড় জমে গিয়েছিল ছাগলখালি মাঠে। মায়ের মৃতদেহের কাছেই হতভম্ব এক কিশোর।
—নাম কী রে তোর? কোত্থেকে এসেছিস? কী করে হল এমন?
চারদিক থেকে উড়ে আসা প্রশ্নের এলোমেলো জবাব দিচ্ছিল ছেলেটা। জানা যায়, তার নাম মৃত্যুঞ্জয় গায়েন। পরে পুলিশের জেরাতেও সে অনেক কথা বলে। সব মিলিয়ে যা উঠে আসে, মৃত্যুঞ্জয়ের বয়ানে তা এ রকম:
মা চেয়েছিল, আশিক নামে ওই লোকটাকে বিয়ে করবে, আমরা এক সঙ্গে থাকব। তাই আমার মাধ্যমিক শেষ হতেই হেমনগরের বাড়ি ছেড়ে নওদার দিকে রওনা দিয়েছিলাম।
আমাদের সঙ্গে ছোট ব্যাগ ছিল। আশিক বলেছিল, প্রথমে সে তাদের বাড়ি নিয়ে যাবে। আমরা টোটোয় চেপে মাঠের কাছে আসি। সেখানে নেমে আশিক টোটোওয়ালাকে ফিরে যেতে বলে। গ্রামের আলো-আঁধারি পথ ধরে আমরা এগোচ্ছিলাম। সামনে আমি, পিছনে মা আর ওই লোকটা। চাপা গলায় তর্ক করছিল দু’জনে। কী নিয়ে, তা ঠিক শুনতে পাইনি।
গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে যাওয়ার পরে অন্ধকার গাঢ় হল। ঝোপঝাড় ঠেলে এগোচ্ছিলাম। ব্যাগটা আমার হাতেই ছিল। আচমকা আশিক পিছন থেকে এসে সেটা কেড়ে নিয়ে দুই থাপ্পড় কষায় আমাকে। আমি পড়ে যাই। ও ডান হাত দিয়ে আমার গলা টিপে ধরে। শ্বাস নিতে পারছিলাম না, জিভ বেরিয়ে আসছিল। নিস্তেজ হয়ে পড়ি। আশিক বোধহয় ধরে নিয়েছিল, মরে গিয়েছি। আমায় ছেড়ে মায়ের দিকে ছুটে যায় ও। খানিকক্ষণ নড়ার অবস্থা ছিল না। মাথা ঝিমঝিম, চোখ অন্ধকার। খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পরে তাকিয়ে দেখি, খানিকটা দূরেই লোকটা মায়ের আঁচল দিয়ে গলায় প্যাঁচ দিয়ে পিছন থেকে টেনে ধরে আছে। ওর বাঁ হাতে মোবাইল। তার আলোয় একটু-একটু দেখা যাচ্ছে। মা ছটফট করতে-করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই লোকটা ডান হাঁটু দিয়ে গলা ঠেসে ধরল জমিতে। দু’এক বার ঝটকা দিয়ে স্থির হয়ে গেল মা। আমি নড়তেও পারলাম না। শরীরে যেন কোনও জোর নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ।
লোকটা কিন্তু তখনই চলে যায়নি। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল, মা নড়ে কি না। আমার হাতে-পায়ে খুব মশা কামড়াচ্ছিল, তবু আমি কাঠ হয়ে শুয়ে ছিলাম। শেষে লোকটা মায়ের নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখল, শ্বাস পড়ছে কি না। জোরে এক বার ঝাঁকাল। তার পরে এ দিক ও দিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল। খানিক পরে উঠে মায়ের কাছে গিয়ে দেখি, সাড় নেই। গা তখনও গরম। কোথাও আলো নেই। মাঝে-মধ্যে শেয়াল-কুকুরের ডাক। কাকে ডাকব? মায়ের পাশেই বসে থাকলাম। এ ভাবে কত ক্ষণ কেটেছে জানি না। একটা সময় আলো ফুটল। আকাশ তখন মেঘে ঢাকা।