মহম্মদ তাঞ্জিল আহমেদ
জুয়াদ আলির বাড়িতে টিভি নেই। পড়শিরা জানান, ছেলে ‘উধাও’ হয়ে যাওয়ার পরে দাওয়ায় বসে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই দুপুর গড়িয়ে যায় তাঁর। রবিবার, তেমনই ঠায় বসে থাকার সময়েই খবরটা এসেছিল। তবে, ‘হারানো’ ছেলের নয়।
—‘‘চাচা শুনছেন তো, তাঞ্জিল সাহেবকে খুন করে দিয়েছে।’’ প্রতিবেশী এক যুবক এসে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন খবরটা। প্রথমটায় বুঝতেই পারেননি জুয়াদ। তবে মুহূর্তেই ঝলসে উঠেছিল সেই বিকেলটা— ঝকঝকে চেহারা। পাতলা গোঁফ, চশমার কাচ মুছে বলছেন, ‘মেহেরবানি কর কে ইয়ে আপ রাখ লিজিয়ে।’ জুয়াদ মনে করতে পারেন— ‘‘অভাবের সংসারে ওই পাঁচশো টাকার নোটটা বড় কাজে দিয়েছিল আমাদের। আমাকে ফল খাওয়ার জন্য দিয়েছিলেন।’’ তা অবশ্য কেনা হয়নি। তবে খাগড়াগড় কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত ছেলে জহিরুলের খোঁজে এলেও কটূ কথা তো দূরে অস্ত্ বরং দিনের পর দিন তিনি বুঝিয়ে গিয়েছেন, ‘কাজটা ভাল করেনি জহিরুল। আসলে ওর দোষ নেই, কোনও ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল জঙ্গিদের সঙ্গে’। জুয়াদ ক্ষিণ গলায় বলছেন, ‘‘বার বার আমাদের বলেছিলেন, ও যদি ফেরে বকাঝকা করবেন না। বরং খবরটা যেন তাঁকেই দেওয়া হয়।’’ কড়া পুলিশি গলা নয়, জুয়াদের কানে এখনও ভাসছে, ‘ইয়ে আপ রাখ লিজিয়ে!’
জুয়াদের মতোই তাঞ্জিলকে মনে রেখেছেন তিনিও। মধ্য চল্লিশের প্রৌঢ় জানাচ্ছেন, পাজামাটা একটু মলিন হয়ে গিয়েছে ঠিকই তবে, সেই পাঞ্জাবিটা এখনও ধরে রেখেছে তার দুধ-সাদা রং। ইস্ত্রি করা টানটান পাঞ্জাবিটায় হাত বুলিয়ে তিনি বলছেন, ‘‘এটা স্যার দিয়েছিলেন। বার কয়েক পড়েছি। আর নয়, তুলে রেখে দেব।’’ রবিবার রাতে তিনি টিভির পর্দায় দেখেছেন স্যারের রক্তাক্ত চেহারাটা। যাঁকে উত্তরপ্রদেশের বিজনৌরে শনিবার রাতে খুব কাছ থেকে ২৪টি গুলি করে খুন করেছে দুষ্কৃতীরা।
টিভিতে তখন গনগনে ক্রিকেট ফাইনাল। বিরতির ফাঁকে খবরের চ্যানেলে চোখ রাখতেই চমকে উঠেছিলেন করিমপুরের ওই প্রৌঢ়। টিভি বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। ম্যাচের বাকি অংশ দূরের কথা, রাতে খেতেও পারেননি।
মাস কয়েক আগে তাঞ্জিলের দেওয়া উপহার—দুধসাদা পাজামা আর কুর্তা হাতে তিনি বলছেন, ‘‘স্যারের কাছ থেকে কিছুতেই এটা নিতে চাইছিলাম না। কিন্তু স্যার বলেছিলেন, আরে ভাই এটা দেখে আমাকে মনে রাখবে।’ সেটাই সরত্যি হয়ে গেল!’’
ওই যুবক একা নন। নদিয়ার করিমপুর ও থানারপাড়ার আরও অনেকেই জড়িয়ে গিয়েছেন এনআইএ অফিসারের স্মৃতিতে। যাঁরা কেউই তাঞ্জিলের সহকর্মী নন, নন আত্মীয়ও।
নদিয়া জেলা পুলিশের এক কর্তা যেমন বলছেন, ‘‘তাঞ্জিল সাহেব আসলে এমনটাই। পুলিশ বা আপনাদের মতো সাংবাদিকরা যাঁদের সোর্স বলেন, তাঞ্জিল সাহেব তাঁদেরই বলতেন দোস্ত।’’ বর্ধমানের খাড়গাগড়ের সুতোয় জড়িয়ে গিয়েছিল নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু এলাকা। করিমপুরের বারবাকপুর, থানারপাড়ার গোমাখালি তেমনই দু’একটা নাম। সেই সময় জহিরুল শেখের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল চল্লিশটিরও বেশি জিলেটিন স্টিক। সেই সূত্রেই নদিয়ার থানারপাড়া ও করিমপুরে একাধিকবার এসেছিলেন তাঞ্জিল। সেই স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে বারবাকপুর।