অনাদর আর উপেক্ষায় ম্লান কৃষ্ণনগরের গরিমা

যার জন্য গর্ব, তার প্রতিই চরম ঔদাসীন্য। সে ঘূর্ণীর মৃৎশিল্প থেকে শুরু করে জিভে জল আনা সরপুরিয়া, সরভাজাই হোক বা কবি নাট্যকার ভূমিপুত্র দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্মৃতিরক্ষাকৃষ্ণনগরের ঐতিহ্য রক্ষায় আগ্রহ নেই কারওনা পুরসভা, না প্রশাসন।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৪ ০০:৫৯
Share:

ঘূর্ণির পুতুল। —ফাইল চিত্র

যার জন্য গর্ব, তার প্রতিই চরম ঔদাসীন্য। সে ঘূর্ণীর মৃৎশিল্প থেকে শুরু করে জিভে জল আনা সরপুরিয়া, সরভাজাই হোক বা কবি নাট্যকার ভূমিপুত্র দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্মৃতিরক্ষাকৃষ্ণনগরের ঐতিহ্য রক্ষায় আগ্রহ নেই কারওনা পুরসভা, না প্রশাসন।

Advertisement

ঘূর্ণীর মৃৎশিল্পের পরিচয় দিতে গিয়ে এক সময় বলা হত এখানকার শিল্পীদের আঙুলের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে ওঠে মাটির পুতুল। দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে সাত সাগর তেরো নদীর পাড়ে বিদেশের মাটিতেও তার কদর যথেষ্ট। মাত্র তিন ইঞ্চির মাটির পুতুলের মুখের চামড়ার ভাঁজ কিংবা চোখের মনি যে ভাবে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা, তাতে অবাক হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। এই তো ক’দিন আগে তরুণ শিল্পী সুবীর পালের হাতের কাজ ‘গ্রামের হাটের দৃশ্য’ দিল্লির ক্রাফট মিউজিয়ামে দেখে মুগ্ধ হয়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন মিশেল ওবামা। অথচ দীর্ঘ দিনের সরকারি উদাসীনতায় সেই শিল্প আজ ধুঁকছে। চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীদের বংশধররা। সুবীরবাবু বলেন,‘‘বিশ্বের বাজারে আমাদের এই শিল্পকর্মের যথেষ্ট সুনাম আছে। বাজার আছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে জিনিসটা নিয়ে যাবে কে? কলকাতার সঙ্গে ভৌগলিক দূরত্ব, উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব সর্বোপরি সরকারি উদ্যোগে কোনও রকম প্রচার না থাকায় প্রতিযোগিতা থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে আমাদের শিল্পকর্ম। বহু বার দাবি জানিয়েও কলকাতাতেই সরকারি উদ্যোগে বিপণন কেন্দ্র খোলাতে পারলাম না।”

কৃষ্ণনগর শহরের প্রান্তে করিমপুরগামী রাজ্য সড়কের পাশে ঘূর্ণির পুতুলপট্টিতেও কী ন্যূনতম পরিকাঠামো করে দিতে পেরেছে প্রশাসন?

Advertisement

এখানে এখন সরকারি নথিভুক্ত শিল্পী ও কারিগরের সংখ্যা ২৭৩১। ৩৫২টি ইউনিট আছে। সরকারি সচিত্র পরিচয়পত্র আছে ১১২০ জন শিল্পীর। কিন্তু অর্থাভাবে সব শিল্পীর পুতুলের কাউন্টার বা দোকান নেই। ৫০টির মতো দোকান আছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারা চান শিল্পীদের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ভাল করে দেখে-শুনে পছন্দসই শিল্পকর্ম কিনতে। কিন্তু এখানে না আছে কোনও খাবারের দোকান, না বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। এতদিন পরে পুরসভা একটা শৌচাগার করে দিয়েছে মাত্র। এত অসুবিধা, ক্রেতারা একবার এলে দ্বিতীয়বার আসতে চান না আর। মূলত ক্রেতার অভাবে ধুঁকছে গোটা পুতুলপট্টি।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভবন ছিল এখানেই।

উদাসীনতার আর এক চরম শিকার শহরের গর্ব কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ১৮৬৩ সালে তিনি এই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে নিয়ে এই শহরের মানুষের গর্বের শেষ নেই। কিন্তু তাঁর স্মৃতিচিহ্নকে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ দেখা যায় না। বছরের শেষে তাঁর ভিটেবাড়ির এক চিলতে জমিতে জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের উপস্থিতিতেই শেষ স্মৃতিরক্ষা। এবার তো অবস্থা আরও খারাপ। বাংলা তারিখ হিসাবে এবার তাঁর জন্মদিন ছিল ২১ জুলাই। ওই দিন ছিল শাসকদলের শহিদ দিবস। ফলে অনুষ্ঠানের প্রথম দিকে পুরপ্রধানকে কিছু সময় দেখা গেলেও ধারে-কাছে পাওয়া গেল না আর কোনও জনপ্রতিনিধিকে। মাত্র ন’জন ছাত্রীর উপস্থিতিতে পালিত হল তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। লোকের অভাবে বাতিল হয়ে গেল প্রভাতফেরি। আর জন্মভিটে? কৃষ্ণনগর স্টেশন সংলগ্ন কবির জন্মভিটের হাজার খুঁজেও সন্ধান পাওয়া যাবে না। নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে কবির বাড়ি। শুধু কৃষ্ণনগর থেকে বহরমপুরগামী রেললাইনের পাশে কবির বাড়ির প্রবেশ পথের দু’টি তোরণ কোনও রকমে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির বাগানের উপর দিয়ে স্টেশন অ্যাপ্রোচ রোড তৈরি হয়েছে। পৈতৃক বসত বাড়ির জমি বিভিন্ন ভাগে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে বাড়িটিও। সেখানে এখন অসামাজিক কাজকর্মের আখড়া। শহরের বাসিন্দা সঞ্জিত দত্ত বলেন, ‘‘কেউই ওঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য উদ্যোগী হয়নি। চোখের সামনে জন্মভিটে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এতদিনে একটা মিউজিয়াম পর্যন্ত তৈরি হল না।’’ চরম উদাসীনতায় এই ভাবেই জীর্ণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য প্রমথ চৌধুরীর বাড়ি রানিকুঠি, ব্রাহ্মসমাজের বাড়ি ইত্যাদি।

“ঘূর্ণীর উন্নতির জন্য একাধিক পরিকল্পনা রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট মিউজিয়াম।

অর্ধেক কাজ হয়ে গিয়েছে। এখানে শিল্পীরা নিজেদের তৈরি সামগ্রী প্রদর্শনের পাশাপাশি বিক্রি করতে পারবেন।

এ ছাড়াও ক্রেতাদের খাওয়া-বিশ্রামের বন্দোবস্ত থাকবে।” পি বি সালিম, জেলাশাসক

“কবির স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কবির নামে সাড়ে তিনশো আসন বিশিষ্ট বাতানুকূল অডিটোরিয়াম

তৈরি করেছি। তাঁর জন্মভিটের যে অংশটুকু এখনও অবশিষ্ট আছে সেই তোরণ দু’টি এখন রেলের সম্পত্তি।

তাই সেখানে কিছু করতে পারছি না। তবে মিউজিয়াম করার পরিকল্পনা আছে। অসীম সাহা, পুরপ্রধান

তবে, কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরভাজা, সরপুরিয়ার মান পড়ে যাওয়ায় যতটা দুঃখ শহরবাসীর, ততটা আর কিছুতে নয়। শোনা যায় এই দুই মিষ্টি আবিষ্কার করেছিলেন কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত শিল্পী অধরচন্দ্র দাস। রেসিপি গোপন রাখতে এই দুই মিষ্টি তৈরির সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতেন তিনি। কিন্তু এক সময় সেটা আর গোপন রইল না। এখন এই সরভাজা বা সরপুরিয়া মিলছে শহরের সব দোকানেই। শহরের ১৬০টির মতো মিষ্টির দোকানের প্রায় সবক’টিতেই সরভাজা, সরপুরিয়া পাওয়া যায়। কিন্তু দিন দিন এই দুই মিষ্টির দাম যে ভাবে বাড়ছে, সেই হারেই মান পড়ছে। শহরের প্রবীণ নাগরিক সুকুমার চৌধুরী বলেন, ‘‘সরপুরিয়া, সরভাজার সেই স্বাদ আর নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বাদ আর গন্ধ কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন