আবেগে ভর করেই চলছে করিমপুরের খেলাধুলা

মাঠের চারপাশে হাজার হাজার কালো মাথার ভিড়। মাইকে ঘোষণা চলছে‘মঞ্চের উপর পুরস্কার দেখতে পাচ্ছেন তো? চ্যাম্পিয়ন দল পাবে দশ কেজি। আর রানার্স দলের জন্য বরাদ্দ ছ’ কেজি।’ কপাল ঠুকে মাঠে নামার সময় খেলোয়াড়রাও আড়চোখে একবার দেখে নিচ্ছেন জলজ্যান্ত সেই নধর পুরস্কার। দর্শকদের চিৎকার, মাইকের আওয়াজ, খেলোয়াড়দের দৃষ্টি উপেক্ষা করে মঞ্চের একপাশে বাঁধা সেই কচি পাঁঠা তখন কচিঘাস চিবোতে ব্যস্ত।

Advertisement

কল্লোল প্রামাণিক

করিমপুর শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৫৪
Share:

খেলার মাঠ বাঁচানোর তাগিদে রাস্তায় খুদেরা।

মাঠের চারপাশে হাজার হাজার কালো মাথার ভিড়। মাইকে ঘোষণা চলছে‘মঞ্চের উপর পুরস্কার দেখতে পাচ্ছেন তো? চ্যাম্পিয়ন দল পাবে দশ কেজি। আর রানার্স দলের জন্য বরাদ্দ ছ’ কেজি।’

Advertisement

কপাল ঠুকে মাঠে নামার সময় খেলোয়াড়রাও আড়চোখে একবার দেখে নিচ্ছেন জলজ্যান্ত সেই নধর পুরস্কার। দর্শকদের চিৎকার, মাইকের আওয়াজ, খেলোয়াড়দের দৃষ্টি উপেক্ষা করে মঞ্চের একপাশে বাঁধা সেই কচি পাঁঠা তখন কচিঘাস চিবোতে ব্যস্ত। ফাইনাল খেলা শেষ। সাঙ্গ হয়েছে পুরস্কার বিতরণও। ভাগের পুরস্কার নিয়ে দুই দল তখন সোল্লাসে বাড়ি ফিরছে---‘হিপ হিপ...হুররে...।’

আজ থেকে বছর দশেক আগেও খেলার পুরস্কার হিসাবে ট্রফি বা নগদ টাকার বদলে দেওয়া হত এমন পুরস্কার। করিমপুর ও লাগোয়া সীমান্তের গ্রামগুলিতে তখন হামেশাই দেখা যেত এমন ফুটবল প্রতিযোগিতা। অভাব ছিল, প্রতিবন্ধকতা ছিল, ছিল পদে পদে বাধাও। তবে সে সবই হেলায় হারিয়ে জয়ী হত স্রেফ আবেগ। আজ পুরস্কারের বদল ঘটলেও প্রতিবন্ধকতা আগের থেকে বেড়েছে বই কমেনি। ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা যায়--- তাহলে করিমপুরের ফুটবলে চলে কীসে? উত্তর আসে‘আবেগে।’

Advertisement

আর সেই আবেগ আর ইচ্ছেশক্তির উপর ভর করেই একসময় করিমপুর ও লাগোয়া এলাকা থেকে উঠে এসেছে একের পর এক ভাল খেলোয়াড়। করিমপুর আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থার প্রাক্তন সম্পাদক দীপঙ্কর সাহা জানান, করিমপুরের প্রদীপ মৈত্র, কার্তিক পাল, সেনপাড়ার গোলাম বিশ্বাস, মোজাম্মেল বিশ্বাস, প্রয়াত অশোক সাহার মতো অনেকেই একসময় কলকাতার পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন মাঠে দাপিয়ে ফুটবল খেলেছেন। একই ভাবে করিমপুরের নিখিল দেবনাথ, সুরেন্দ্র জৈন, অরুণ বিশ্বাস, অভিজিৎ স্বর্ণকার, সুবিনয় সরকার কিংবা অরূপ সাহার মতো এই এলাকার অনেকেই ক্রিকেট খেলেও সুনাম অর্জন করেছেন। একসময়ের রাজ্য স্তরের ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় রঞ্জিত দত্ত, প্রাক্তন ফুটবলার প্রদীপ সরখেল, দীনেশ রায় ও মোহন সিহির মতো প্রবীণ মানুষেরা আজও এলাকার তরুণদের উৎসাহ দিতে নিয়মিত খেলার মাঠে আসেন।

করিমপুরের বাসিন্দা তথা গোয়াশ হাই স্কুলের শিক্ষক কার্তিক পাল বলছেন, “প্রতিবন্ধকতা তখনও ছিল, আজও রয়েছে। তবে সে সবকে জয় করে খেলাধুলাটা চালিয়ে যাওয়াটাই তো সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ।” নিজের সেই সব অতীতের কথা বলতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েন কার্তিকবাবু। তিনি জানান, সময়টা আটের দশক। তাঁর বাবা মাটির কাজ করতেন। সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। খুব ভোরে উঠে বাবার সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে হত। সকাল সকাল সেই কাজ শেষ হয়ে গেলে তারপর তিনি স্কুলে যেতেন। বিকেলে নিয়ম করে খেলার মাঠে। কার্তিকবাবুর কথায়, “সে এক পাগলামি বলতে পারেন। খেলার নেশায় কত কী যে করেছি তা ভাবলে এখন নিজেরই হাসি পায়। এখনকার ছেলেরা সে সব কল্পনাই করতে পারবে না।” একই কথা বলছিলেন প্রদীপ মৈত্র, মানবেন্দ্র বিশ্বাসরাও।

“আমাদের এক বাড়ি থেকেই পাঁচ ভাই ক্রিকেট খেলতাম। বাড়ির লোকজনও ক্রিকেটের ভক্ত ছিল। ফলে মাঠে টিফিন থেকে শুরু করে খেলার সরঞ্জাম কোনও কিছুরই অভাব রাখতেন না বাড়ির লোকজন। এ সব কিছু আমরা গোটা টিমের মধ্যে ভাগ করে নিতাম। সে সব দিন এখন কোথায়! এই টিম স্পিরিটটাই তো এই প্রজন্মের মধ্যে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।” বলছিলেন সুরেন্দ্র জৈন।

ক্রিকেট প্রশিক্ষণ চলছে।

অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তীর্থঙ্কর বিশ্বাস। পেশায় ব্যবসায়ী তীর্থঙ্করবাবু বলছিলেন, “তখন কলকাতার কলেজে পড়ি। হস্টেলে থাকতাম। বন্ধুদের মুখে শুনলাম কুচাইডাঙায় বড় ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে ভোরের ট্রেন ধরে সোজা খেলার মাঠে। খেলা শেষ করে ফের বাসে কৃষ্ণনগর, সেখান থেকে কলকাতা। অনেক পরে বাড়ির লোকজন বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন। এমনই নেশা ছিল খেলা নিয়ে।”

এই করিমপুর থেকেই এশিয়াডে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বুদ্ধদেব মণ্ডল, সুবল মণ্ডলরা। এলাকার মানুষের আক্ষেপ, সেই ধারাটা আর বজায় রাখা গেল না। করিমপুর থেকে আরও বড় খেলেয়াড় উঠতে পারত। কিন্তু খেলার পরিবেশটাই ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারও কোন হেলদোল নেই। সীমান্তের এই প্রত্যন্ত এলাকা সবদিক থেকে বঞ্চিতই থেকে গেল! একসময় যাঁদের খেলা দেখতে মুখিয়ে থাকত হাজার হাজার দর্শক, সেই খেলোয়াড়দের অনেকেই এখন দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন।

করিমপুর আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৭৬ সালে ক্রীড়া সংস্থা তৈরি হয়। এলাকার বিভিন্ন ক্লাবগুলোকে এই সংস্থার আওতায় আনা হয়। চেষ্টা করা হয় নতুন খেলোয়াড় তুলে আনতে। সেই সব খেলোয়াড়দের বেশ কয়েকটি বিভাগে ভাগ করে শুরু হয় লিগের খেলা। ১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে সিনিয়র প্রথম ডিভিসন ক্রিকেট লিগ ও ১৯৯৪-৯৫ সাল থেকে সিনিয়র দ্বিতীয় ডিভিসন ক্রিকেট লিগ শুরু হয়। ওই বছরেই চালু হয় জুনিয়র ক্রিকেট লিগ। ১৯৭৬-৭৭ সাল থেকেই সিনিয়র প্রথম ডিভিসন ফুটবল লিগ শুরু হয়। তার প্রায় এগারো বছর পরে অর্থাৎ ১৯৮৭-৮৮ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় ডিভিসন ফুটবল লিগ। সেই বছরই দ্বিতীয় ডিভিসন ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় ধোড়াদহ ইয়ুথ ক্লাব। রানার্স হয় শিশা নেতাজি ক্লাব। ১৯৮১-৮২ সাল থেকে সাব জুনিয়র (অনূর্ধ্ব ১৫ বছর) ফুটবল লিগ ও ১৯৮৯-৯০ থেকে জুনিয়র (অনূর্ধ্ব ১৯ বছর) লিগ শুরু হয়।

করিমপুরের খেলাধুলার এই পড়তি দশার জন্য কিছুটা স্কুল কর্তৃপক্ষকেও দায়ী করেছেন ক্রীড়া সংস্থার প্রাক্তন সম্পাদক দীপঙ্কর সাহা। তাঁর কথায়, “খেলাধুলায় যাঁদের সবথেকে বেশি উৎসাহ দেওয়ার কথা, সেই শারীরশিক্ষার সিংহভাগ শিক্ষকরাই তো মাঠে আসেন না! ছাত্র-ছাত্রীরা তাহলে আসবে কী করে? অনেক অভিভাবকও খেলাধুলার থেকে বেশি জোর দিচ্ছেন টিউশন ও ভাল রেজাল্টের উপর। সে সব তো অবশ্যই দরকার। কিন্তু তারমধ্যে খেলাধুলাটা থাকলেই বা ক্ষতিটা কোথায়?”

ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক সুজিত বিশ্বাস বলেন, “আমরাও লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছি। গত কয়েক বছরে খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেশ কিছুটা বেড়েছে। সংস্থার অধীনে এলাকার প্রায় ৫০ টি জেলা ক্রীড়া সংস্থার অনুমোদনপ্রাপ্ত ক্লাব রয়েছে। এলাকার কিছু সহৃদয় মানুষ ও স্থানীয় করিমপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েত আমাদের নানা ভাবে সাহায্যও করছে। তবে সরকার থেকে সেই অর্থে তেমন সহযোগিতা আমরা পাই না।”

তিনি জানান, দিন দিন খেলার মাঠের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। যেগুলো রয়েছে সেখানেও বিস্তর সমস্যা। এলাকায় একটা স্টেডিয়ামেরও খুব দরকার। সে বিষয়ে জেলা প্রশা

এতকিছু প্রতিবন্ধকতার পরেও আশার আলো বলতে এইটুকুই!

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন