ইফতারের ভোজে আজ উদার বহরমপুর

সবুজে-মোড়া শহরটা বদলে গেল। পথের দু’পাশে গালিচার মতো সবুজ ঘাস আর নেই। রেঙ্গুন থেকে নিয়ে আসা রেনট্রি দিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা শহরটাকে সবুজে মুড়ে দিয়েছিল। আজ উধাও সেই সবুজস্নিগ্ধ ছায়া। কয়েক কদম অন্তর পুকুর ছিল। তারাও আজ উধাও। সেই পথেই বিদায় নিয়েছে বহরমপুরে ইফতারের সাবেকি সংস্কৃতিও।

Advertisement

অনল আবেদিন

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৪ ০১:২২
Share:

প্রস্তুতি। বহরমপুর গোরাবাজারে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

সবুজে-মোড়া শহরটা বদলে গেল। পথের দু’পাশে গালিচার মতো সবুজ ঘাস আর নেই। রেঙ্গুন থেকে নিয়ে আসা রেনট্রি দিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা শহরটাকে সবুজে মুড়ে দিয়েছিল। আজ উধাও সেই সবুজস্নিগ্ধ ছায়া। কয়েক কদম অন্তর পুকুর ছিল। তারাও আজ উধাও। সেই পথেই বিদায় নিয়েছে বহরমপুরে ইফতারের সাবেকি সংস্কৃতিও।

Advertisement

এ সবই আজ মনে পড়ছে গোরাবাজার এলাকার প্রয়াত জমিদার গোলাম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বড় ছেলের। তাঁর নাম মহম্মদ আব্দুল কাদের গোলাম মফিজুদ্দিন চৌধুরী। কাবুল চৌধুরী নামেই অবশ্য শহরে তাঁর সমধিক পরিচিতি। ছেষট্টি বছরের কাবুলের স্মৃতির সরণিতে পাঁচ-ছয় দশক আগের শহরের ইতিহাস আনাগোনা করার প্রধান সূত্র কিন্তু সামনে রাখা ফলাহার দিয়ে সুসজ্জিত ইফতারের থালা।

কাবুল বলেন, “আমি নিজে দেখেছি আমাদের বাড়িতে এক-দেড় মন চালের ভাত রান্না করার মতো পিতলের বিশাল হাঁড়িতে ইফতারের আয়োজন করা হত।” সেই তালিকায় ছিল কাবাব, টিকিয়া, হালিম, নানরুটি, পিঁয়াজি-বেগুনি। সুজি, মসকত, ছোলা, পোস্তা, চালকুমড়ো— আরও কত কিসিমের হালুয়া বানানো হত। ওই ফিরিস্তি পেশ করে কাবুলের আক্ষেপ, “রোজার দিনে বিশেষ ধরনের বিরিয়ানি রান্না হত রোজদারদের খাওয়ানোর জন্য। শহর থেকে বাঘ শেয়াল উধাও হওয়ার মতোই ইফতারের সেই রাজকীয় আয়োজনেরও গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়েছে।”

Advertisement

রোজার মাস জুড়ে ৫ ওয়াক্ত, অর্থাৎ ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ৫ বার নামাজ পড়ার পরও রাতে তারাবির নামাজ পড়তে হয়। তারাবির নামাজ পড়ার পর রাত ১০টা নাগাদ ঘুমনোর আয়োজন। রোজার উপবাস শুরু করার জন্য ফের রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ খেতে হয় সেহেরি। সেই সেহেরি রান্নার জন্য রাত আড়াইটেয় ঘুম থেকে উঠতে হয়। সারাদিন নিরম্বু উপবাসের পর ক্লান্ত অবসন্ন দেহ রাত ১০টা ঘুমিয়ে পড়ে রাত আড়াইটেয় জাগা কার্যত অসম্ভব। গভীর রাতে সেই জাগিয়ে দেওয়ার কাজটি কেউ করেন মসজিদে মাইকের সাহায্যে ডেকে দিয়ে। অথবা মোবাইল ফোনের অ্যালার্মের মাধ্যমে। কিন্তু মসজিদে মাইক ও মোবাইল প্রযুক্তি তো হাল আমলের। তার আগে?

সেও এক মন কেমন করা কাহিনি। হাতে লণ্ঠন ও লাঠি নিয়ে এই বহরমপুর শহরে ৫-৭ জনের ‘রাত জাগানিয়া’ দল বের হত পথে প্রান্তরে। এ রকম দল ছিল প্রতিটি পাড়ায়। মুখে তাঁদের ‘নাতে রসুল’ (হজরত মহম্মদের প্রশংসা সূচক গান) ও কাওয়ালি। সেই সুরের মাঝেই রাতের নৈঃশব্দ খান খান করে হাঁক পাড়তেন ‘ওঠো রোজদার! সেহেরির সময় হল!’ ওই রাত জাগানিয়ারা আসতেন সাধারণত দরিদ্র সম্প্রদায় থেকে। এক মাস রোজার উপবাসের পর ঈদের আগের দিন গৃহস্থরা তাঁদের নতুন পোশাক, খাদ্য খাবার অথবা অর্থ দিতেন। গোরাবাজার এলাকার এ রকম এক রাতজাগানিয়ার নাম মানসুর শেখ। পেশায় রিকশাচালক মানসুর বলেন, “মোবাইল ফোন আর মাইক আমাদের সেই কাজ কেড়ে নিয়েছে।” ইফতারের মেনুতেও এসেছে পরিবর্তন। তিনি বলেন, “এখন এই শহরেই মিলছে প্যাকেট বন্দি হলদিরামের সিমাই-সহ রকমারি পদ।”

ইফতার বিলি করারও রকমসকম পাল্টেছে। মাদ্রাসা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির রাজ্য কমিটির নির্বাহী সভাপতি সৈয়দ নুরে খোদার বাড়ি বহরমপুর শহরে। তিনি বলেন, “আগে ইফতার বিলি করা হত আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষ সবার মধ্যে। এখন ফ্ল্যাট কালচারের সঙ্গে সেই সর্বজনীন মানসিকতাও পাল্টেছে।” সরকারি চাকুরে স্বামীর সঙ্গে গ্রাম থেকে বহরমপুর শহরে এসে থাকছেন গৃহবধূ নাসরিন পারভিন। বললেন, “ফ্ল্যাটবাড়িতে প্রত্যেকে নিজের মতো থাকি। এক ছাদের তলায় হলেও, প্রতিবেশিতা তেমন করে গড়ে ওঠেনি। হঠাৎ ইফতারে ডাকলে অনেকে চমকে যাবে। তাই ঘনিষ্ঠদেরই ডাকি।”

অনেকের আফশোস, রাজনৈতিক দলের সুবাদে ইফতার মজলিস এখন হয়ে গিয়েছে ইফতার পার্টি। দলীয় কর্মী-সমর্থক-নেতাদের নিয়ে চলছে ইফতার পার্টি। এটাকে রাজনৈতিক অবক্ষয় বলেই মনে করছেন তাঁরা। কিন্তু অনেকে আবার একমত নন। এ শহরের বাসিন্দা তথা ইতিহাস গবেষক খাজিম আহমেদ মনে করেন, ইফতার এখন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে না থেকে, সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। সব সম্প্রদায়ের মানুষ ইফতার পার্টিতে আসছেন। তিনি বলেন, “গ্রামের রাজনৈতিক অশান্তি এড়াতে আর শহরের লেখাপড়া ও চিকিৎসার সুযোগ নিতে বিগত আড়াই দশক ধরে নবোত্থিত মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায় বহরমপুর শহরে বাড়ি করে বা ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করছে। প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব ক্রমশ সর্বজনীন চরিত্র অর্জন করতে চলেছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন