নিহত সেলিনা।—নিজস্ব চিত্র।
পাশাপাশি বাড়ি। নাসিমা বিবির বছর সাতেকের ছেলে ও বছর এগারোর মেয়ের সঙ্গে খেলা করত হাসিনারা বিবির ছয় বছরের মেয়ে সেলিনা। হাসিনারা কোনও কারণে বাড়ির বাইরে গেলে নাসিমার কাছেই মেয়েকে রেখে যেতেন। রবিবার বিকেলেও মেয়েকে নাসিমার কাছে রেখে গ্রামেরই এক আত্মীয়ের বাড়িতে পিঠে করতে গিয়েছিলেন হাসিনারা।
সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ নাসিমা হাসিনারাকে বলে, সেলিনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ির পাশে সর্ষে খেতে সেলিনার দেহ মেলে। সন্দেহ হওয়ায় গ্রামবাসীরা নাসিমাকে চেপে ধরেন। প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে নাসিমা তার অপরাধের কথা স্বীকার করে নেয় বলে গ্রামবাসীদের দাবি। নাসিমাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আটক হয় স্থানীয় দুই যুবককেও।
সেলিনাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান। শিশুটির কানে সোনার দুল ছিল। দেহ উদ্ধারের পরে দুল পাওয়া যায়নি। ধৃত ওই মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার ঘরের একটি টিনের বাক্স থেকে সেই দুল উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধৃত ওই মহিলা খুনের কথা কবুল করেছে বলে দাবি জেলা পুলিশেরও। পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “পারিবারিক শত্রুতার জেরে এই খুন, নাকি অন্য কোনও কারণ রয়েছে, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।”
কেন প্রতিবেশী মহিলার হাতে এক শিশুকে খুন হতে হল? হাসিনারা বলছেন, ‘‘ওদের সঙ্গে আগে গণ্ডগোল ছিল। কিন্তু পরে সম্পর্ক ভাল হয়ে যায়। সেই রাগ হয়তো এত দিন মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল। তবে আমার মেয়ের কানে সোনার দুলের জন্যই ওরা খুন করেছে বলেই আমাদের মনে হচ্ছে।’’ পুলিশের অনুমান, পাশাপাশি দুই পরিবারের পুরনো শত্রুতা রয়েছে। তবে রবিবার সন্ধ্যায় ওই শিশুটি সম্ভবত এমন কিছু দেখে ফেলেছিল যার জেরে তাকে খুন হতে হল।
নদিয়ায় এমন ঘটনা অবশ্য এই প্রথম নয়। কখনও প্রতিবেশীর সঙ্গে পুরনো বিবাদ, কখনও সম্পত্তির লোভে পরিবারেই কোনও প্রিয়জন বদলা নিতে বারবার শিশুদের অপহরণ, খুন করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে হাঁসখালি ও বগুলা এলাকায় এ রকম অন্তত গোটা পাঁচেক ঘটনা ঘটেছে। যা রীতিমতো চিন্তায় ফেলে দিয়েছে জেলার পুলিশ প্রশাসনকে। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘যে ভাবে একের পর এক শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে, তাতে এই অপরাধের শিকড় সমাজের অনেক গভীরে বলেই আমাদের মনে হচ্ছে। বিশেষ করে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় এই ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে।’’ জেলার পুলিশ কর্তারা ঢুকতে চাইছেন সমস্যার গভীরে। জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, ‘‘যে ভাবে সামান্য সামান্য পারিবারিক বিবাদে শিশুদের নৃশংস ভাবে খুন করা হচ্ছে, সেটা সত্যিই উদ্বেগের। বিষয়টি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আমরা সমাজতত্ত্ববিদদেরও সাহায্য নেব।’’
প্রায় প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ মিল পাচ্ছে অপরাধের ধরনের মধ্যেও। এর আগে বেথুয়াডহরিতেও একই ভাবে এক শিশুকে অপহরণ করে খুন করা হয়েছিল। পরে বাড়ির পাশেই তার পচাগলা মৃতদেহ বস্তা বন্দি অবস্থায় পাওয়া যায়। এই ঘটনায় পুলিশ শিশুটির জেঠু-সহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। চাপড়ার ডোমপুকুরেও অপহরণ করে খুন করা হয়েছিল এক শিশুকে। তার মৃতদেহটিও বাড়ির কাছেই একটি পাট খেতে ফেলে রাখা হয়েছিল। সেই ঘটনাতেও খোয়া গিয়েছিল শিশুটির কানের দুল। এই ঘটনাতেও পুলিশ এক নিকটাত্মীয়-সহ তিনজন প্রতিবেশীকে গ্রেফতার করেছিল। সম্প্রতি হাঁসখালির গাঁড়াপোতাতে এক শিশুকে অপহরণ করে খুন করা হয়। সেখানেও পুলিশ ওই শিশুর এক আত্মীয়-সহ ছ’জনকে গ্রেফতার করে।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ দেখেছে, মূল অপরাধীরা প্রথম দিকে খোঁজাখুজির সময় সেই দলের ভিতরে থেকে সকলকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। এমনকী পরিবারের শুভাকাঙ্খী হিসাবে পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। সব ঘটনাতেই পরিবারের কোনও সদস্যের সঙ্গে বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পত্তি বা অন্য কোন বিষয় নিয়ে গণ্ডগোল ছিল। আর তারই বদলা নিতে পরিবারের সব থেকে কনিষ্ঠ সদস্যটিকে অপহরণ করে খুন করা হয়েছে। আর সেই খুনের ঘটনায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিশুকে তারাই ডেকে নিয়ে গিয়েছে, যাদের ওই শিশু ও তার পরিবার সম্পূর্ণ বিশ্বাস করত। সব ক্ষেত্রেই শিশুটিকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। মৃতদেহও উদ্ধার হয়েছে বাড়ির পাশ থেকে।
আর এই সবটাই হচ্ছে বদলা নেওয়ার তীব্র ইচ্ছে থেকে। শিশুরা সহজ শিকার, তাই প্রতিপক্ষকে আঘাত করতে তাদেরকেই খুন করা হচ্ছে। মনোবিদ শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী বলেন, “এখন পরিবারগুলো ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে। যৌথ পরিবারের ধারনাটাই ভেঙে গিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে জ্ঞাতি ঘরানাও। আগে একই পরিবারের সদস্যদের মধ্য একটা নাড়ির টান ছিল। কিন্তু এখন আর সে সব নেই। তার পরিবর্তে এখন জায়গা করে নিয়েছে লোভ, আরও ভাল থাকার বাসনা। ফলে এখন সম্পর্কের থেকেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ বড় হয়ে উঠছে। আর এ সবই হচ্ছে সামাজিক হতাশা থেকে।” হতাশা এমনই, যে তা বিবেকের দংশনও ভোঁতা করে দেয়। তাই প্রতিবেশী বা নিকট আত্মীয়ের বাচ্চাকে খুন করতে এতটুকু দ্বিধা হচ্ছে না লোকের।