খরচ বাঁচাতে চৈত্রেই তৈরি ‘রেডিমেড’ দুর্গা

গাছ ভরেছে পলাশে। কোকিল ডাকছে। পাতে এখনও শেষ শীতের কপি। পুজোর কথা ভাবার এই কি সময়? এটাই সময়, বলছেন তেহট্টের কুমোরপাড়ার শিল্পীরা। শুধু বলছেন না, কোমর বেঁধে নেমেও পড়েছেন প্রতিমা গড়তে। চৈত্রের চড়া রোদে সার দিয়ে শুকোচ্ছে ‘রেডিমেড’ দুর্গা। কোথাও শিল্পীরা খড় বাঁধছেন দড়িতে, কোথাও মাটির প্রলেপ পড়ছে খড়ে।

Advertisement

সুজাউদ্দিন

তেহট্ট শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৪ ০০:৫৮
Share:

শুরু হয়ে গিয়েছে প্রতিমা তৈরির কাজ। তেহট্টের পলাশিপাড়ায় কল্লোল প্রামাণিকের তোলা ছবি।

গাছ ভরেছে পলাশে। কোকিল ডাকছে। পাতে এখনও শেষ শীতের কপি। পুজোর কথা ভাবার এই কি সময়?

Advertisement

এটাই সময়, বলছেন তেহট্টের কুমোরপাড়ার শিল্পীরা। শুধু বলছেন না, কোমর বেঁধে নেমেও পড়েছেন প্রতিমা গড়তে। চৈত্রের চড়া রোদে সার দিয়ে শুকোচ্ছে ‘রেডিমেড’ দুর্গা। কোথাও শিল্পীরা খড় বাঁধছেন দড়িতে, কোথাও মাটির প্রলেপ পড়ছে খড়ে। ছোট-বড়, নানা মাপের প্রতিমা তৈরি চলছে জোরকদমে।

পুজো সেই অক্টোবরের গোড়ায়। তা হলে এত তাড়া কীসের? শিল্পীরা জানাচ্ছেন, বাড়তি লক্ষ্মীলাভের আশাতেই আগাম দুর্গা তৈরি। বাঁশ, খড় ও মাটির দাম এই সময়টা কম থাকে। মজুরও মেলে সহজে। “পুজোর সময়ে যে প্রতিমা বানাতে খরচ পড়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা, তা এখন আড়াই হাজারেই হয়ে যায়,” বললেন দত্তপাড়ার শিল্পী সোমনাথ পণ্ডিত। “পুজোর সময়ে কাজের চাপটাও কমে।”

Advertisement

পুজোর আগে বাঁশের চাহিদা বাড়ায় দাম বাড়ে। খড়ের দামও হয় আকাশ ছোঁওয়া। নদীতে জল থাকায় পুজোর মরসুমে মাটির দামও বাড়ে। এ দিকে, এই সময়টা মাঠে কাজ থাকে না বলে সহকারী হিসেবে শ্রমিক পাওয়া যায় সহজে। মজুরি হয় নাগালের মধ্যে। তাছাড়া বড় মণ্ডপের পাশাপাশি এখন পাড়ায়-পাড়ায় ছোট পুজো কমিটির দাপট। ফলে প্রতিমার চাহিদা বেড়েছে অনেক। অর্ডার পাওয়ার পর গড়তে বসলে সময়ে জোগান দেওয়া কঠিন হয়। তাই আগে থেকেই ‘রেডিমেড’ প্রতিমা গড়ে রাখার চল হয়েছে ইদানীং।

সেই সঙ্গে কাজের উৎকর্ষের যুক্তিও দেখালেন কেউ কেউ। মৃৎশিল্পী মঙ্গলময় পালের কথায়, “পুজোর সময়ে এতটাই চাপ পড়ে আমাদের ঘাড়ে, যে নাওয়া-খাওয়ার আর সময় থাকে না। শেষ সময়ে তুলির টানটাও ভাল ভাবে হয় না। পুজো কমিটির লোকেরা খুঁতখুঁত করেন। আগাম প্রতিমা গড়ে রাখলে হাতে অনেকটা বেশি সময় পাওয়া যায়। ধীরে-সুস্থে প্রতিমা করতে পারি।”

কারণ আছে আরও একটা। ওই এলাকার অনেক মৃৎশিল্পী ভিন্ রাজ্যে প্রতিমা গড়ার কাজ করেন। এই সময়টা তাঁরা অধিকাংশই বাড়িতে থাকেন। বসে না-থেকে বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে প্রতিমা গড়ার কাজে হাত লাগান তাঁরা। হাঁসপুকুরিয়া নতিপোতা এলাকার প্রশান্ত, অশোক, প্রদীপ ও সন্দীপ পালেরা গোরক্ষপুর, জব্বলপুর, হায়দরাবাদে মৃৎশিল্পীর কাজ করেন। প্রশান্তের কথায়, ‘‘ওখানে কাজ হালকা থাকায় এই সময়টা ছুটি পাই সহজে। এখানে এসে প্রতিমা তৈরি করি। এতে পরিবারের উপর চাপ কমে, টাকাও বাঁচে।”

কিন্তু এতগুলো মাস কী করে সংরক্ষণ হবে প্রতিমার? বর্ষায় নষ্ট হবে না? এলাকার মৃৎশিল্পীরা জানান, বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে পাটকাঠির ছাউনির উপর ত্রিপল টাঙানো হয়। তার পরেও কোনও অংশ ভিজে-গলে নষ্ট হলে আবারও মাটির প্রলেপ লাগিয়ে পুজোর সময় রং করা হয়। পলাশি পাড়ার শিল্পী অখিল কর্মকারের কথায়, ‘‘আগের মতো বন্যা হলে আগাম প্রতিমা গড়ে রাখা সম্ভব হত না। এখন ভৈরব দিয়ে জলঙ্গিতে আর জল ঢোকে না। ২০০০ সালের পর তেহট্ট এলাকায় কোনও বন্যা হয়নি।”

কিন্তু শাস্ত্রমতে, রথে কাঠামো পুজোর পরেই তো প্রতিমা গড়ার কথা। প্রবীণ এক শিল্পী হেসে বলেন, “এই বাজারে অতশত ভাবলে চলে না। দু’পয়সা যদি বেশি আসে ঘরে, দোষের কী?” স্থানীয় পুরোহিত দর্পনারায়ণ ভট্টাচার্যও জানান, এতে দোষের কিছু দেখছেন না তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা মায়ের রূপ দেন, তাঁরা কতটা অর্থকষ্টে থাকেন, ভাবা যায় না। আগাম ক’টা প্রতিমা গড়ে যদি ওদের একটু সুরাহা হয়, ভালই তো।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন