গোপীনাথ নেই, মেলা নিয়ে শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

গোপীনাথহীন বারোদোল যেন শিব ছাড়া যজ্ঞ। অথচ সবকিছু ঠিক সেই আগের মতো। নদিয়া রাজবাড়ির ছড়ানো নাটমন্দিরের পূর্ব দিকের খিলানের নিচে পাশাপাশি রাখা হয়েছে বারোটি সুসজ্জিত কাঠের সিংহাসন। তার প্রতিটি আলো করে রয়েছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে প্রতিষ্ঠিত নানা কৃষ্ণবিগ্রহ। ব্যতিক্রম কেবল একটি সিংহাসন। বারোদোলের প্রধান আকর্ষণ গোপীনাথকে এবার আসতে দেওয়া হয়নি।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৪ ০১:২৫
Share:

বারোদোলের মেলার প্রস্তুতি তুঙ্গে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

গোপীনাথহীন বারোদোল যেন শিব ছাড়া যজ্ঞ। অথচ সবকিছু ঠিক সেই আগের মতো। নদিয়া রাজবাড়ির ছড়ানো নাটমন্দিরের পূর্ব দিকের খিলানের নিচে পাশাপাশি রাখা হয়েছে বারোটি সুসজ্জিত কাঠের সিংহাসন। তার প্রতিটি আলো করে রয়েছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে প্রতিষ্ঠিত নানা কৃষ্ণবিগ্রহ। ব্যতিক্রম কেবল একটি সিংহাসন। বারোদোলের প্রধান আকর্ষণ গোপীনাথকে এবার আসতে দেওয়া হয়নি। কুড়ি ইঞ্চি উচ্চতার কষ্টিপাথরের সেই চেনা গোপীনাথ মূর্তির আসন এবার তাই শূন্য। মধ্যযুগের ভাস্কর্যের এক অতুলনীয় নিদর্শনের বদলে সেখানে স্থান পেয়েছে গোপীনাথের একটি দ্বিমাত্রিক ছবি। দেবতাহীন সেই শূন্য আসনই যেন এবারের বারোদোলের মেলার সব রঙ কেড়ে নিয়েছে। যাঁকে ঘিরে বারোদোল, সেই গোপীনাথকে এবার আসতে দেওয়া হচ্ছে না। এটা স্পষ্ট হতেই বারোদোলের মেলা ঘিরে উঠছে হাজারো প্রশ্ন। চৈতন্যদেবের নির্দেশে গোবিন্দ ঘোষ প্রতিষ্ঠিত অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ নদিয়ার মানুষের বড় প্রিয়। তাঁর টানে আসা হাজার হাজার মানুষকে নিয়েই কয়েক শতাব্দী আগে কোনও এক চৈত্রে জমে উঠেছিল বারোদোলের মেলা। তারপর দিন যত গড়িয়েছে ততই লোকমুখে ছড়িয়েছে মেলার খ্যাতি। প্রাচীনত্ব এবং জনপ্রিয়তার বিচারে এ তল্লাটে বারোদোলের মেলার কোনও জুড়ি নেই। সেই বারোদোলের মেলায় এবারই প্রথম থাকছেন না গোপীনাথ। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই বাস্তব। আর বাস্তবের এই রুক্ষ মাটিতে দাঁড়িয়ে বারোদোলের মেলাকে ঘিরে জমেছে আশঙ্কার মেঘ। রাজবাড়ির বর্তমান প্রধান সৌমিশচন্দ্র রায় বলেন, “আমরা নানা ভাবে চেষ্টা করলাম। কিন্তু এবারে আর গোপীনাথকে পেলাম না। একবার ভেবেছিলাম তিনিই যখন থাকছেন না তখন মেলারও দরকার নেই। কিন্তু পড়ে মনে হল মেলার ভিড়েই মানুষ তাঁদের প্রিয় দেবতাকে খুঁজে পাবেন। সুতরাং মেলা যেমন হয় তেমনই হবে।” অন্য দিকে, নদিয়ার মানুষ মেলাকেই বেছে নিয়েছেন গোপীনাথকে ফেরানোর মাধ্যম হিসেবে। এলাকার বিশিষ্ট জনদের নিয়ে তৈরি হয়েছে শ্রীগোপীনাথ ও বারোদোল উৎসব মঞ্চ। মেলা শুরুর আগের দিন, বৃহস্পতিবার ওই মঞ্চের সদস্যরা বসেছিলেন তাঁদের কর্মসূচি ঠিক গোপীনাথ ফেরাতে একমাস ধরে মেলার মাঠে মঞ্চ বেঁধে চলবে প্রচার। উত্তমবাবু জানান, গোপীনাথ ও মেলার ইতিহাস থেকে শুরু করে কীভাবে এই অবস্থা তৈরি হল সবই সাধারণ মানুষকে জানানো হবে। দশ বারো জনের একটা দল মেলার ওই মঞ্চ থেকে এই ইতিহাস বলবেন। মাঝে মাঝে বিশিষ্ট জনেরা, প্রবীণ মানুষেরা তাঁদের অনভুতির কথা বলবেন। তৈরি হচ্ছে অডিও সিডি, লিফলেট। ইতিমধ্যে রাজবাড়ির তরফ থেকে এই ব্যাপারে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যানার, ফ্লেক্স লাগানো হয়েছে। সংগ্রহ করা হবে মেলায় আগত মানুষের স্বাক্ষর, ফোন নম্বর এবং তাঁদের মতামত। এভাবে যা সংগ্রহ হবে, সেসব নিয়ে প্রশাসনের কাছে দরবার করা হবে।

Advertisement

অন্যদিকে বারোদোল মেলা কমিটির সম্পাদক সুবীর ঘোষ বলেন, “গোপীনাথহীন বারোদোলে বাণিজ্য কতটা সফল হবে তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। সকলেই তো আসেন গোপীনাথের টানে। তারপরে কেনাকেটা। কিন্তু গোপীনাথই তো আসছেন না। ফলে অন্য বারের মতো মানুষ এ বার আসবে কিনা বুঝতে পারছি না।”

আশঙ্কাটা সুবীরবাবুর একার নয়, রাজবাড়ির চকের মাঠের বেশ কয়েক হাজার বর্গমিটার জুড়ে ছড়ানো মেলা প্রাঙ্গণে কান পাতলে এখন এমন আশঙ্কার কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে। মেলার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে এক বাণিজ্যক সংস্থার বাজার। সেখানে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব ক’টি রাজ্যের হস্তশিল্পের জমজমাট বিকিকিনি চলে। এবারেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু সব দেখে শুনে তাঁরাও উদ্বিগ্ন। এক বাণিজ্যিক সংস্থার তরফে সঞ্জন দাস এবং পূর্ণেন্দু রায় বলেন, “সব মিলিয়ে মোট ৫৫টি স্টল নিয়ে এই বাজার। গত বছর পর্যন্ত খুব ভাল বাণিজ্য হয়েছে। কিন্তু এবার গোপীনাথ না আসয় আমরাও বিশেষ ভরসা পাচ্ছি না।”

Advertisement

জনশ্রুতি আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর দ্বিতীয় মহিষীর মেলা দেখার ইচ্ছাপূরণের জন্য রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এক মেলার আয়োজন করেছিলেন। সেই রানি একবার নদিয়ারাজের কাছে সেকালের বিখ্যাত উলার ‘জাতের মেলা’ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজকার্যের চাপে মহারাজ সে কথা বেমালুম ভুলে যান। তাছাড়া সেকালের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কোনও রানির পক্ষে উলার মেলা দেখা শোভনীয় ছিল না। তাই মহিষীর আবদার রাখতে একটা আস্ত মেলা বসিয়ে ফেলেন রাজবাড়ির মােঠে। এই সেই বারোদোলের মেলা। বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার- নদিয়া, ১৯১০ সালের রিপোর্টে লিখেছিল, ‘সেবারে বারোদোলের মেলায় ২০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল এবং মেলা রাজবাড়ির হলেও তাতে সাধারণ মানুষই প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন।’

বারোদোলের মেলাকে বর্তমান সঙ্কট থেকে উদ্ধার করতে সেই ‘সাধারণ মানুষ’ কতটা সদর্থক ভূমিকা পালন করেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের উত্তরসূরিদের পাশাপাশি তাকিয়ে আছেন নদিয়ার মানুষও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন