আদালতের অলিন্দে অনিল রায়। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা যা পারেননি, তাই-ই করে দেখালেন বহরমপুর জজকোর্টের এনডিপিএস এজলাসের পেশকার, অর্থাৎ প্রধান করণিক অনিল রায়।
আদালত মানেই নানা ছুতোয় কর্মবিরতি। সেই প্রবণতা রুখতে কড়া বার্তা দিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। ওই দৃষ্টান্তের অনেক আগেই আদালতের এক কাজ পাগল কর্মী নীরবে কাজ করে যাওয়ার অনোন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তিনি অনিল রায়। ৪৩ বছরের চাকরি জীবনে এক দিনের জন্যেও ছুটি নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টে রবিবারেও আদালতে হাজির থেকে কাজ তুলেছেন। সেই অনিলবাবু শুক্রবার চাকরি থেকে অবসর নিলেন।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, তিনি অসুস্থ হয়েও ছুটি নেননি? সহকর্মী স্বপন চৌধুরী বলেন, ‘‘তিনি অসুস্থ হয়েছেন এবং আদালতে আসেননি এমন ঘটনাও কখনও ঘটেনি!’’ ছুটি উপভোগের প্রচলিত পথ ছেড়ে অনিলবাবু কেন অন্য পথে হাঁটলেন? অনিলবাবুর মন্তব্য, ‘‘জনগণের টাকা থেকে সরকার বেতন দেয়। কাজ না করে বেতন না নেওয়াটা অন্যায় হবে।’’ একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, ‘‘আদালতে কাজের পাহাড় জমে রয়েছে। ছুটির বদলে কাজ করলে সেই চাপ কিছুটা হলেও কমবে। মানুষেরও ভাল হবে।’’ বহরমপুর জজকোর্ট ছাড়াও তিনি কাজ করেছেন কান্দি ও বহরমপুর মহকুমা আদালতে। বহরমপুর উকিলসভার সম্পাদক শুভাঞ্জন সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘বহরমপুর ও কান্দি সর্বত্রই তিনি ছুটির দিনেও আদালতের কাজ করেছেন। বর্তমান কর্ম-সংস্কৃতির যুগে অনিলবাবু অনোন্য দৃষ্টান্ত।’’
চাকরি জীবনের মতো পারিবারিক ও ব্যক্তি জীবনে তিনি ব্যতিক্রমী। বাবা সমীরকুমার রায় ছিলেন বহরমপুর কালেক্টরেটের কর্মী। একার রোজাগারে পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে নিয়ে মোট ১২ জনের সংসার চালানো তাঁর কাছে যথেষ্টই চ্যালেঞ্জের ছিল। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালে, বিএ তৃতীয় বর্ষের লেখাপড়া শিকেয় তুলে দিয়ে আদালতের চাকরিতে প্রবেশ করেন অনিলবাবু। বোনেদের বিয়ে দিতে গিয়ে নিজের বিয়ে করার সময় পেরিয়ে গিয়েছে কবেই!
অকৃতদার অনিলবাবুর মাতৃভক্তিও এই শহরের অনেকের কাছে রূপকথার মতো। তাঁর দুই মা। তাঁর কথায়, ‘‘মা প্রতিমারানি রায় ও বড়মা কালী।’’ গত মে মাসে ৯৭ বছর বয়সে প্রতিমাদেবী প্রয়াত হয়েছেন। ১৯৯৫ সালে তাঁর বাবা মারা গিয়েছেন। তারপর থেকে মা প্রতিমাদেবী আর দেবী দীপান্বিতার প্রতি ভক্তি তাঁর আরও বেড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘‘ভূ-ভারতে এমন কোনও মন্দির বা তীর্থক্ষেত্র নেই যেখানে মাকে নিয়ে যাইনি। ১৯৮৩ সাল থেকে মাকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশের সব তীর্থক্ষেত্রে গিয়েছি। পুজোর সময় মাস খানেক ও ডিসেম্বর মাসে ১০ দিন আদালত ছুটি থাকে। ওই সময় মাকে নিয়ে তীর্থ দর্শনে বেরিয়ে পড়তাম।’’
প্রতিমাদেবী শেষ বয়সে হাঁটতে পারতেন না। সহকর্মী স্বপন চৌধুরী জানালেন, ডবল ইঞ্জিনের অ্যাম্বাসাডার ভাড়া করে হুইল চেয়ারে মাকে বসিয়ে তীর্থক্ষেত্রে বেরিয়ে পড়তেন অনিলবাবু। মা মারা গিয়েছেন মাস পাঁচেক আগে। এ দিন আদালতের কাজ থেকে অবসর। এখন কী করবেন? ছোট্ট জবাব, ‘‘দীন-দুখিনী, ভিখারি-আর্তের সেবা করব। আর দেবদেবীর পুজো।’’
সহকর্মীরা এ দিন অনিলবাবুর হাতে তুলে দেন পিতলের তৈরি মোমদানি, প্রদীপ ও ধূপদানি। এমন উপহার কেন? সহকর্মীদের ব্যাখ্যা, ‘‘এর আগে তিনি যেখান থেকে যা পেয়েছেন সবই গরিব-ভিখারিকে দান করে দিয়েছেন। তাই বিদায় সংবর্ধনা প্রদীপ, মোমদানি ও ধূপদানির ব্যবস্থা!’’