দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে কলতলায় বাসনগুলো কোনওরকমে নামিয়ে দে ছুট দে ছুট সেই দুপুরগুলো কবেই হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা। পানের খিলি মুখে ঠেসে দিয়ে ষাঁট ছুঁই ছুঁই প্রাক-বার্ধ্যেকর আড্ডায় হারানো সেই দিন ফিরে পাওয়ার একটা উচ্ছ্বলতা ফিরে আসছে আবার। ম্যাটিনি শো-এর সেই সব দুপুরে মতোই ফিরে আসছে ছেলেপুলেদের ইভনিং না হয় বেশি রাতের ছবি দেখার দিনগুলোও।
যমজ শহর জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ফিরে পাচ্ছে আস্ত একটা সিনেমা হল। পাক্কা ছত্রিশ বছর পরে। সেই কবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল লক্ষ্মী টকিজ। তার পর, ‘‘গুপীবাঘার ফিরে আসার মতোই যেন সিনেমা হলের প্রত্যাবর্তন ঘটল’’, বলছেন মধ্য পঞ্চাশ আমিনা খাতুন।
যা নিয়ে শহরের চায়ের দোকান থেকে, পুরনো শহরের পাড়ার মোড়ে আলোচনা— সিনেমার ফিরে আসা।
এ যাবত, মুর্শিদাবাদের ওই শহরের মানুষের সিনেমা-দর্শন মানে ছিল তেইশ কিলোমিটার রাস্তা উজিয়ে বহরমপুরের হলে সিনেমা দেখা। জেলা সদরের খান তিনেক হল আর হালের মাল্টিপ্লেক্স— সিনেমার ঠিকানা ছিল এই ক’টিই। বাকিটা নিছকই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো টিভি না হয় ভিডিও পার্লার। তবে, সে সব পার্লারে আর ‘ভাল বই’ কোথায়? হা হুতাশ করছেন পুরনো বাসিন্দা বিজয় পাল। আজ, রবিবার সেই দীর্ধশ্বাসে দাঁড়ি পড়তে চলেছে। প্রেমদিবসের বিকেলে জিয়াগঞ্জে চুড়িপট্টি এলাকায় উদ্বোধন হতে চলেছে একটি আধুনিক সিনেমা হলের। যার সাজানো আসন, ডলবি সাউন্ড ঝকঝকে স্ক্রিন-এ, প্রথম শো-এ ‘দিলওয়ালে’ কিংবা অঞ্জন দত্ত পরিচালিত ‘ব্যোমকেশ’ দেখতে মুখিয়ে রয়েছে জিয়াগঞ্জ।
নব্য সেই হলের নাম মহাবীর জৈন মিউনিসিপ্যাল কালচারাল হল। কেন? আড়াই বছর আগে, অশীতিপর রাজকুমার জৈন পুরসভাকে দান করেছিলেন ৬৮ বছরের ঐতিহ্য মাখা তাঁর সিনেমা হল ‘লক্ষ্মী টকিজ’। ভোটের আগে প্রায় দেড় কোটি টাকায় সেই হলটি সাজিয়ে গুছিয়ে তুলছে সিপিএম শাসিত স্থানীয় পুরসভা।
প্রয়াত রাজকুমারের ইচ্ছানুসারে হলের নামকরণ হচ্ছে মহাবীর জৈন মিউনিসিপ্যাল কালচারাল হল’।
বন্দর-শহর জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ মধ্যযুগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। চিত্রশিল্পী ইন্দ্র দুগার এই শহরেরই ভূমিপুত্র। কীর্তন সম্রাজ্ঞী রাধারানিদেবীও জন্মেছেন এখানে। সেই শহরেই এ বার ওই হল যেন তার সংস্কৃতির মুকুটে আরও একটি গোলাপ-পাপড়ি গুঁজে দিল। এমনই মনে করছেন স্থানীয় শিক্ষক যতীন দাস।
২০১৩ সালে লক্ষ্মী টকিজ পুরসভাকে হস্তান্তর করার সময় রাজকুমার জানিয়েছিলেন—১৯৭৮ সাল থেকে লক্ষ্মী টকিজ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। অনেকেই সেটি কেনার জন্য প্রস্তাব দিলেও বিক্রি করেননি তিনি। পুরপ্রধান শঙ্কর মণ্ডল বলেন, ‘‘লক্ষ্মী টকিজ পেলে পুরসভা সেটিকে সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলবে কথা দিয়েছিল। তাই সিনেমা হল হিসেবেই তার ফের আত্মপ্রকাশ।’’
কিন্তু, মাল্টিপ্লেক্সের ঠেলায় সর্বত্র যখন পাট গুটোচ্ছেন হল মালিকেরা তখন এই হল কি বাজার ধরতে পারবে? শঙ্করবাবু আশাবাদী। বলছেন, ‘‘দেখুন না হলটা যে কোনও মাল্টিপ্লেক্সের সঙ্গে পাল্লা দেবে।’’ তিনি হিসেব দিচ্ছেন— সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড্ হল। অ্যাকুয়াস্টিক শুনলে বুঝতেই পারবেন না কোন দিক থেকে আওয়াজ। এমন আর কোথাও নেই।’’ থাকছে, চা, কফি রেঁস্তোরাও।
পুরনো বাসিন্দারা স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন, লক্ষ্মী টকিজ আর শঙ্কর টকিজ দু’টো হলকে আঁকড়ে গড়ে ওঠা দোকানপাট আর ব্যবসার। হারানো সেই সব দোকান অবশ্য আর খোলেনি। শঙ্করবাবু আশ্বস্থ করছেন, ‘‘দেখুন না সে সবও ফিরবে একে একে।’’ স্থানীয় বাসিন্দা ভগবৎ ধারা বলছেন, ‘‘সে যাই থাক, আস্ত একটা সিনেমা হল তো, কত দিন পর সিনেমা ফিরল বলুত তো শহরে!’’
আর, পুরনো বাসিন্দা সুজয় সরকার বলেন, ‘‘কত দিন পরে গিন্নির সঙ্গে নাইট শোয়ে ছবি দেখতে যাব! শেষ দেখেছিলাম উত্তম-সুচিত্রা। এ বার ব্যোমকেশ দিয়ে ফের শুরু।’’ এর বেশি জিয়াগঞ্জ আর কী চায়?