গাঁয়ের লোকেরা জমি দিচ্ছে না। শুধু জমি না পাওয়ার কারণে মুর্শিদাবাদের রানিনগরে অঙ্গনওয়াড়ির ১১টি বাড়ি তৈরির টাকা ফেরত গেল। কংগ্রেস পরিচালিত রানিনগর ২ পঞ্চায়েত সমিতির দাবি, অনেক বুঝিয়েও তারা জমিদানে রাজি করাতে পারেনি। যদিও এলাকাবাসীর অভিযোগ, সেই ভাবে জমি খোঁজার কোনও চেষ্টাই হয়নি। পঞ্চায়েত সমিতির গয়ংগচ্ছ মনোভাবের জন্যই ফেরত যাচ্ছে টাকা।
পদ্মার ভাঙন, এক ফসলি চরের জমি, অপুষ্টিপিছিয়ে পড়া সীমান্তের ওই এলাকায় সমস্যা অনেক। এখনও অনেক চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। নেই বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পানীয় জল, রাস্তা। এই প্রেক্ষিতে সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি চালু হলে লেখাপড়ার পাশাপাশি সেখানে এক বেলা পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা হত। কিছুটা হলেও সীমান্তের ওই গ্রামগুলির সামাজিক উন্নয়ন ঘটত বইকি। সেই জন্যই সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পে রানিনগর ২ পঞ্চায়েত সমিতি ৭৬ লক্ষ টাকা পেয়েছিল অঙ্গনওয়াড়ির বাড়ি তৈরিতে।
বাড়ি তৈরির জায়গা না পাওয়ায় সেই টাকাই ফিরে যাচ্ছে এখন। পঞ্চায়েত সমিতির দাবি, অনেক চেষ্টা করেও বাড়ি তৈরির জন্য জমি পায়নি তারা। রানিনগর ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘এখন মানুষ আর স্বেচ্ছায় জমি দিতে রাজি নন। সকলেই জমির বদলে চাকরি চাইছেন। অন্তত সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পে সহায়িকার কাজটা পেলেও জমি দিতেন লোকজন। কিন্তু সেই নিয়ম নেই এখানে। ফলে জমি পাওয়া যাচ্ছে না।”
গাঁয়ের লোকেরা প্রকারান্তরে সে কথা মেনে নিচ্ছেন। তবে, জমি দেওয়ার লোকজন যে একেবারে নেই, এমনটা নয়। কেউ-কেউ রাজি থাকলেও সেই জমি নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা টাকার খেলা খেলবেন ভেবে পিছিয়ে আসছেন। রানিনগর থানার মরিচা গ্রামের আবু সায়েদ বলেন, ‘‘আমার কাছে পঞ্চায়েত সমিতি জমি চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি। কারণ আমরা জমি দেব, আর সেই জমিতে অঙ্গনওয়াড়ি বানিয়ে লাখ-লাখ টাকা দিয়ে কর্মী-সহায়িকার চাকরি বিক্রি করবেন নেতারা।” বাবলাবোনার কুদ্দুস শেখের কথায়, ‘‘দানের জমিতে শিশুদের থেকে নেতাদের লাভ বেশি, তাই জমি দিতে রাজি হইনি।”
এই চাপানউতোরে বছরখানেক টাকা পড়ে থাকার পর শেষমেষ ফেরত যাচ্ছে। আর তাতেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে এলাকায়। রানিনগরের আমিরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা কাজেম আলির কথায়, ‘‘সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পের কেন্দ্রগুলি হলে সীমান্তের গ্রামগুলির অনেক উন্নতি হত। কেবল শিশুদেরই নয়, এই এলাকার শিক্ষিত বেকার মহিলাদের কর্মসংস্থানও হত। এই টাকা ফেরত যাওয়া মানে আমাদের এলাকার জন্য বড় ক্ষতি।” অনেকে আবার মনে করছেন, পঞ্চায়েত সমিতি জমি পাওয়ার জন্য খুব একটা চেষ্টা করেনি। রানিনগরের সিডিপিও তপন কুমার সাহা বলেন, ‘‘আমাদের ব্লকে মাল্টি সেক্টর ডেভলপমেন্ট প্রোজেক্টে ১০০টি ও ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট প্রকল্পে ৬টি সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পের বাড়ি হয়েছে। সেগুলি সবই হয়েছে দানের জমিতে। ফলে মানুষ জমি দিতে চাইছে না, এই অজুহাত ঠিক নয়। বোঝাতে হবে লোকদের।” রানিনগর ২-এর বিডিও সুব্রত মজুমদার বলছেন, ‘‘ইতিমধ্যে এমএসডিপি প্রকল্পে ১০টি সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পের বাড়ি তৈরির টাকা পেয়েছি। আমরা লোকজনের কাছে গিয়ে তাঁদের বারবার করে এর গুরুত্ব বুঝিয়েছি। এই ভাবে ১০টি বাড়ির জন্য আমরা জমিও পেয়েছি। অথচ ওই পঞ্চায়েত সমিতি ১১টা বাড়ির একটিরও জায়গা খুঁজে পেল না। এখন ওই টাকা ফেরত দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।”
বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক ভাবেও চাপানউতোর শুরু হয়েছে। কংগ্রেসের একাংশ দল পরিচালিত পঞ্চায়েত সমিতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক কংগ্রেস নেতা বলেন, ‘‘কেবল সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পের নয়, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে প্রায় ১০ কোটি টাকা পড়ে আছে। কোথাও ঠিকাদারি নিয়ে গণ্ডগোল, কোথাও ভাগ নিয়ে গণ্ডগোল। যার জেরে রানিনগরের উন্নয়ন স্তব্ধ। আমরা দলীয় ভাবে এর মোকাবিলা করতে গেলেও নেতৃত্বের বড় একটা অংশ বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে।” সিপিএমের লোকেরা আবার অভিযোগ করছেন, তাঁদের সময়ে বরাদ্দ টাকায় অঙ্গনওয়াড়ির বাড়ি তৈরিতেও নাকি বাধা দিচ্ছেন পঞ্চায়েত সমিতি কর্তৃপক্ষ। সিপিএমের রানিনগর জোনাল কমিটির সম্পাদক সাজাহান আলির অভিযোগ, ‘‘আমাদের সময়ে বরাদ্দ হওয়া রামনগর নয়নসুখ পাড়ায় একটি সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পের বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল কিছু দিন আগে। সেটাও ওরা ঠিকাদারকে করতে দিচ্ছে না। টাকা চাইছে।”