পড়ন্ত বিকেলে মণ্ডপের মাইক নাগাড়ে আউড়ে চলেছে---‘আর একটু পরেই শুরু হবে বোলান। পালার নাম হরিশচন্দ্র শৈব্যা। তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজ সেরে চলে আসুন...।’
মাইকে ঘোষণা চলাকালীন বেলডাঙা শিব মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল ছোট ট্রাক। এক এক করে নামলেন রাজা হরিশচন্দ্র ও দলের আরও অনেকে। বারবার পোশাক পাল্টাতে ঝামেলা হয় বলে সকলে সাজপোশাকে একেবারে তৈরি হয়েই এসেছেন। কিন্তু ভোটের বাজারে এমন পালা কেন? ফস করে একটা বিড়ি ধরিয়ে উত্তরটা দিলেন হরিশচন্দ (ভাল নাম অবশ্য বিধানচন্দ্র দাস, নিবাস কালিগঞ্জ), “ভোট মানে তো চারপাশের এই দেওয়াল লিখন, ফ্লেক্স-ফেস্টুন, নেতা-নেত্রীদের গরম গরম বক্তৃতা এইসব। ভোট কিংবা রাজনীতির বিষয় নিয়ে এর আগেও পালা করেছি। কিন্তু তাতে অনেক মানুষ বেজার হন। কাজের কাজও কিছু হয় না। তার থেকে এই হরিশচন্দ্র, শিব-দুগ্গাই ঢের ভাল।”
বছর তিনেক আগে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের আগে ও পরে বেশ কিছু জেলায় বোলান গানে উঠে এসেছিল রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। কোথাও কোথাও সেই পালায় নটনটীরা মমতা-বুদ্ধের চরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। রাজনীতির গরমাগরম তরজায় সেই পালা ‘হিট’ও হয়েছিল। কিন্তু গাজন উপলক্ষে মুর্শিদাবাদে এ বারের বোলান শিল্পীরা ব্যস্ত থাকলেন অন্য পালা নিয়ে। ভোট-রাজনীতি নিয়ে রা কাড়লেন না।
নওদার বিপ্লব ঘোষ বোলানে বিবেকের ভূমিকায় বেশ কয়েক বছর ধরেই অভিনয় করছেন। বিপ্লববাবু বলছেন, “বোলানে বহু ক্ষেত্রে উঠে আসে সমসাময়িক প্রসঙ্গ। তা বিশেষ কোনও ঘটনা হতে পারে আবার রাজনীতির বিষয়ও হতে পারে। কিন্তু রাজনীতির বিষয় নিয়ে পালা করাটা অনেক সময় সমস্যার হয়ে দাঁড়ায়।” তিনি জানান, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে পালার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় একটা বার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, অনেক সময় সেই বার্তার অন্যরকম মানে করে নেওয়া হয়। তখন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিপ্লববাবু বলেন, “পাশাপাশি আমরা নিজেরাও ভোট নিয়ে আর খুব বেশি উত্সাহী নই। ভোট হয়তো এবারও দিতে যাব। তবে তেমন বুঝলে ‘নোটা’তে (নো ওয়ান অফ দ্য অ্যাবাভ) বোতাম টিপব।”
প্রতি বছর শেষ চৈত্রে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বীরভূম ও বর্ধমানের বিস্তীর্ণ এলাকায় জমে ওঠে বোলানের আসর। শক্তিপুর স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক তথা লোক গবেষক প্রদীপনারায়ণ রায় জানান, রাঢ় বাংলায় বহু বছর আগে এই গান শুরু হয়। পরে তা আশপাশের অন্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। তারপর গ্রামবাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় বোলানের মতো লোকগানেও ধীরে ধীরে সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। কিন্তু রাজনীতি কিংবা ভোট থেকে কী দূরে থাকতে চাইছেন বোলান শিল্পীরা? প্রদীপবাবু বলছেন, “বিধানসভা কিংবা গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে স্থানীয় সমস্যাকে কেন্দ্র করে বোলানের বেশ কিছু পালা লেখা হয়েছিল। ছিল রাজনীতির প্রসঙ্গও। কিন্তু তা সবটাই ছিল সমালোচনামূলক। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে, ওই পালা নিয়ে স্থানীয় রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গে বেশ কিছু জায়গায় ভুল বোঝাবুঝিও হয় বোলান শিল্পীদের। সেই কারণেই হয়তো বোলানে রাজনীতির প্রসঙ্গটা শিল্পীরা সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন।”