টোটো আর রিকশার দ্বন্দ্ব শুরু, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নবদ্বীপে

সময়টা ১৯৩৭ সাল। নবদ্বীপ পুর-কর্তৃপক্ষ শহরের পথে নতুন এক ধরনের যান চলাচলের অনুমতি দিলেন। অদ্ভুত-দর্শন তিন চাকার সেই গাড়ি টানার জন্য ঘোড়া বা গরু-মোষের দরকার পড়ে না। মনুষ্যচালিত সেই গাড়ির নাম রিকশা। নবদ্বীপ পুরসভা প্রথম দশটি রিকশার অনুমোদন দেয় যখন, সেকালের ঘোড়ার গাড়ির চালকেরা যথেষ্ট বাধা দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে সেই রিকশাই আবার টোটো বা টুকটুক ঠেকাতে কোমর বেঁধে নেমেছে ময়দানে। তবে রিকশারাজের দাপট কমায় টুকটুকের উপরে সন্তুষ্ট শহরবাসী।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৪ ০০:৩৩
Share:

টোটোর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন।নিজস্ব চিত্র।

সময়টা ১৯৩৭ সাল। নবদ্বীপ পুর-কর্তৃপক্ষ শহরের পথে নতুন এক ধরনের যান চলাচলের অনুমতি দিলেন। অদ্ভুত-দর্শন তিন চাকার সেই গাড়ি টানার জন্য ঘোড়া বা গরু-মোষের দরকার পড়ে না। মনুষ্যচালিত সেই গাড়ির নাম রিকশা। নবদ্বীপ পুরসভা প্রথম দশটি রিকশার অনুমোদন দেয় যখন, সেকালের ঘোড়ার গাড়ির চালকেরা যথেষ্ট বাধা দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে সেই রিকশাই আবার টোটো বা টুকটুক ঠেকাতে কোমর বেঁধে নেমেছে ময়দানে। তবে রিকশারাজের দাপট কমায় টুকটুকের উপরে সন্তুষ্ট শহরবাসী। আচমকাই যেন গতি বেড়েছে প্রাচীন এই শহরের। শুধু একটাই সমস্যা। হাজার পাঁচেক রিকশার দাপটে এমনিতেই শহরের নাভিশ্বাস ওঠে। টুকটুকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানজটও বেড়ে চলেছে।

Advertisement

নবদ্বীপের একমাত্র যাত্রিবাহী যান হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে শহরের পথশাসন করে চলেছে রিকশা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নবদ্বীপের অর্থনীতির পর্যটন নির্ভরতা বেড়েছে। গঙ্গার দু’ধারে গড়ে উঠেছে নতুন-নতুন মঠমন্দির,অতিথি আবাস। প্রায় সারা বছর জুড়েই কোনও না কোনও উৎসবে ব্যস্ত নবদ্বীপ। দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাপট বেড়েছে রিকশার। প্রাচীন শহর নবদ্বীপের গলিবহুল সঙ্কীর্ণ পথঘাটে রিকশা ছাড়া অন্য কিছু চলার অবশ্য জো-ও নেই। তাই নবদ্বীপে কার্যত একচেটিয়া রিকশারাজ চলছে আট দশক ধরে।

সুদীর্ঘ এই সময়ে রিকশার বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। অস্বাভাবিক বেশি ভাড়া নেওয়া, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, নবদ্বীপের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে বহিরাগতদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করাতালিকা দীর্ঘ। এমনকী নবদ্বীপ পুরসভা নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা পর্যন্ত মানেন না এই শহরের রিকশাচালকেরা। এই শহরে রিকশা চড়তে হলে চালকদের মনপসন্দ ভাড়া দিয়ে, তাঁদের ঠিক করা বিশেষ কয়েকটি মন্দিরেই যেতে হবে পর্যটককে। দরাদরি করলে শুনতে হবে তীব্র বিদ্রূপ মেশানো কটূক্তি। তালিকার বাইরে নিজের পছন্দের মন্দিরে যেতে চাইলে ভাড়া শুনে মাথা ঘুরে যাবে পর্যটকের। এই সমস্ত নানা কারণে পর্যটক, বলা ভাল খোদ শহরের বাসিন্দাদের কাছেও ক্রমশ ভয়ের কারণ হয়ে উঠছিল রিকশা।

Advertisement

সময় ২০১৪ সাল। দোল উৎসবে লাখো মানুষের ভিড়ে বদলের রঙ লাগল শহরের যানচিত্রে। উৎসব নগরীর বুকে দেখা গেল এক নতুন ধরনের যানশব্দ-গন্ধের দূষণহীন ব্যাটারিচালিত রঙিন রিকশা। প্রথম দর্শনেই পছন্দ করে ফেললেন শহরের মানুষ। কেউ বলেন টোটো, কেউ বলেন টুকটুক। রিকশা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ মানুষ যে বিকল্পের সন্ধান করছিলেন, তা পেয়ে গেলেন টোটোর মধ্যে। ফল, মার্চ থেকে অগস্ট ছ’মাসেই নবদ্বীপে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা প্রায় দেড়শো ছুঁই ছুঁই (নথিভুক্ত ১৩৬) সংখ্যাটা প্রতিদিন বাড়ছে। ভাড়াও মোটামুটি নির্দিষ্ট। গন্তব্য যেখানে হোক না কেন ভাড়া দশ টাকা। নবদ্বীপ নাগরিক কমিটির সম্পাদক দিলীপ চটোপাধ্যায় বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরে অটো চালু করার দাবি ছিল নবদ্বীপে। বদলে টোটো এল। দূষণহীন এই যান আরও ভাল। তবে, স্ট্যান্ড, রুটএগুলো করতে হবে। ন্যূনতম ভাড়া ১০ টাকার বদলে ৫ টাকা হলে ভাল হয়। চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।”

এ দিকে, টোটোর জনপ্রিয়তা দেখে তাকে ঠেকাতে মাঠে নেমেছে সাধারণ রিকশা। ঠিক যেমনটা সেই ১৯৩৭ সালে রিকশা ঠেকাতে নেমেছিল ঘোড়ার গাড়ি। রোজগার হারানোর ভয়ে ভীত সাধারণ রিকশা চালকেরা শহরের স্টেশন, খেয়াঘাট, বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট, পোড়ামাতলার মতো বিভিন্ন স্ট্যান্ডে হেনস্থা করছেন বলে অভিযোগ টোটো চালকদের। তাঁদের অভিযোগ, কোথাও আটকে রাখা হচ্ছে চালককে, কোথাও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে চাবি। কোথাও আবার ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এসব করেও ঠেকানো যাচ্ছে না টোটোর গতি।

এক দলের রুটি-রুজি হারানোর ভয়, অন্য দলের সামনে উপার্জনের নতুন দিশাএই দু’য়ের দ্বন্দ্ব ঠেকাতে আসরে নেমেছে নবদ্বীপ পুরসভা। নবদ্বীপের পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা বলেন, “সময়ের সঙ্গে সব কিছুতেই বদল আসবে, সেটা মেনে নিতেই হবে। নবদ্বীপের মতো আন্তর্জাতিক মাপের পর্যটন কেন্দ্র শুধু মাত্র রিকশা সর্বস্ব হতে পারে না। পাশাপাশি শহরের বহু মানুষ, যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাঁদের যেন অসুবিধা না হয় সেটাও দেখতে হবে।” বিমানকৃষ্ণবাবু বলেন, “এক্ষেত্রে নবদ্বীপ পুরসভা কার্যত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে চলেছে। আমরা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থেকে শহরের রিকশা চালকদের ব্যাঙ্ক ঋণ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। অনেকটাই কথা এগিয়েছে।”

কারা পাবেন ঋণ?

পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে লাইসেন্স আছে এমন রিকশা চালকেরাই পাবেন টোটো কেনার জন্য শর্ত সাপেক্ষে ঋণ। একজন চালককে কুড়ি হাজার টাকা ব্যাঙ্ককে দিতে হবে নগদে। বাকিটা কিস্তিতে শোধ করতে হবে। ইতিমধ্যে আড়াইশো দরখাস্ত পড়েছে পুরসভার কাছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল নবদ্বীপ পুরসভার নথিভুক্ত রিকশা চালকের সংখ্যা ১৯৯৯। এরা সকলেই যদি ব্যাটারি রিকশার জন্য আবেদন করেন এবং শর্ত পূরণ করে কেনেন, তাহলে পথের চেহারা কেমন দাঁড়াবে? এমনিতেই শহরে প্রতিদিন পুরসভার অনুমোদিত প্রায় দু’হাজার রিকশা চলে। সঙ্গে চলে কয়েকশো ভ্যান রিকশা। তাছাড়া নবদ্বীপের চারপাশের খান পাঁচেক পঞ্চায়েতে আরও হাজার দেড়েক অতিরিক্ত রিকশা চলাচল করে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় পাঁচ হাজার। দেড়শো টুকটুকেই নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে নবদ্বীপের রাস্তাঘাটের। প্রতি মোড়ের মাথায় যখন-তখন যানজট। সংখ্যাটা আরও বাড়লে কী হবেভাবতেই শিউরে উঠছেন শহরবাসী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন