ডোমকলে থেকে আনিসুর ঝাঁপালেন প্রচারে

রিমোটটা টেনে নিয়ে টিভির আওয়াজটা একটু বাড়িয়ে দিলেন তিনি। ডিভিডিতে চলছে তাঁরই পুরনো বক্তৃতা। ২১ ইঞ্চি কালার টিভির স্ক্রীন জুড়ে তাঁর নিজের মুখ। অভ্যস্ত আঙুলে কখনও ‘পজ’, কখনও ‘রিওয়াইন্ড’। সাতসকালে নেট প্র্যাকটিস চলছে নাকি? মুচকি হাসেন তিনি। পরনে চেক লুঙ্গি, সুতির হালকা ফতুয়া। বাইরে তখন চাঁদি ফাটা রোদ।

Advertisement

সুজাউদ্দিন

ডোমকল শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ০০:২৩
Share:

প্রার্থীর সঙ্গে প্রচারে। জলঙ্গিতে ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিত্‌ রাউত।

রিমোটটা টেনে নিয়ে টিভির আওয়াজটা একটু বাড়িয়ে দিলেন তিনি। ডিভিডিতে চলছে তাঁরই পুরনো বক্তৃতা। ২১ ইঞ্চি কালার টিভির স্ক্রীন জুড়ে তাঁর নিজের মুখ। অভ্যস্ত আঙুলে কখনও ‘পজ’, কখনও ‘রিওয়াইন্ড’। সাতসকালে নেট প্র্যাকটিস চলছে নাকি? মুচকি হাসেন তিনি। পরনে চেক লুঙ্গি, সুতির হালকা ফতুয়া। বাইরে তখন চাঁদি ফাটা রোদ। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সাদা অ্যাম্বাসাডার। এক এক করে চলে এসেছেন দলীয় কর্মীরাও। পোশাক বদলে দুধসাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। ঘাড়ের পিছনে ঘামে ভেজা পাউডার।

Advertisement

তিনি আনিসুর রহমান। ডোমকলের বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী। এখন ডোমকলের বাড়িতে থেকে পুরোদস্তুর কর্মীর ভূমিকায়। কখনও দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে প্রচার, কখনও সভা। প্রার্থী না হয়েও তিনি সমান ব্যস্ত। ডোমকলকে যে তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন।

সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ঘিরে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। নির্বাচন কমিশন থেকে তাঁকে শো কজও করা হয়। আনিসুর বলেন, “তার জবাবে আমি জানিয়ে দিয়েছি যে, বক্তব্যে কাউকে আক্রমণ করার ইচ্ছে আমার ছিল না। তারপরেও যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।” দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে কৃষক সভার এক সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে তিনি অশালীন মন্তব্য করেছিলেন। পরে অবশ্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন। তবে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে দিয়ে প্রচারের ‘ঝঁুকি’ নিতে চায়নি সিপিএম নেতৃত্ব।

Advertisement

আনিসুর বলছেন, “শরীরটা সেভাবে আর সঙ্গ দিচ্ছে না। স্নায়ুর সমস্যায় ভুগছি। তাই বাড়িতে থেকে দলের হয়ে খাটছি।” গলায় কী ঈষত্‌ অভিমান ঝরে পড়ল? দ্রুত প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় ঠিক ঠাহর হয় না। ‘‘এলাকার নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা আছে। মানুষও জানেন রাজ্য জুড়ে কী চলছে। কথা বললেই তো ওদের গা জ্বালা করে।”ফের সেই চেনা মেজাজে আনিসুর।

মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে চারটি রয়েছে বামফ্রন্টের দখলে। গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনেও এই লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪ লক্ষ ৮ হাজার ভোট। বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৪ লক্ষ ৪০ হাজার। বাম শিবিরের দাবি, লোকসভা কংগ্রেসের দখলে থাকলেও বিধানসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামেদের পাল্লা বেশ ভারি। মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের বাম প্রার্থী বদরুদ্দোজা খান বলছেন, “আনিসুরদা পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। ভাল বক্তা। এই এলাকাকেও আর পাঁচ জনের থেকে অনেক বেশি চেনেন। আমাকে সঙ্গে করে যেভাবে নানা জায়গায় সভা করছেন তাতে জয়ের ব্যাপারে আমি প্রায় নিশ্চিত।” আনিসুরও আশাবাদী, “কংগ্রেসের সাংসদ নিজের ছেলের ঠিকাদারির জন্য কিছু রাস্তা ছাড়া আর তো কিছুই করেননি। তার জবাবও দেবেন সাধারণ মানুষ।”

যা শুনে কংগ্রেস নেতাদের কটাক্ষ, “এখন ডুবন্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন হয়েছেন আনিসুর। আলিমুদ্দিন মুখ বাঁচাতে তাঁকে বসিয়ে রেখেছে। আর উনি ডোমকলে এসে বড় বড় কথা বলছেন।” টানা দু’বারের জয়ী সাংসদ তথা এবারের কংগ্রেসের প্রার্থী মান্নান হোসেন বলছেন, “গত লোকসভা নির্বাচনে উনি তো নিজেই হেরে গিয়েছেন। তিনি আবার অন্য আর একজনকে জেতাবেন কী করে? এসব না করে উনি রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিলেই ভাল করতেন।” তাঁর সংযোজন, “গতবার আমি জেতার পর সব করে দিয়েছিএমন দাবি করছি না। কিন্তু মুর্শিদাবাদ লোকসভা এলাকায় গত দশ বছরে যা কাজ করেছি বামফ্রন্ট বিশ বছরেও তা করতে পারেনি। এখনও কিছু কাজ বাকি আছে। মানুষ সুযোগ দিলে সেই কাজও শেষ করব।”

এই লোকসভা কেন্দ্রে এতদিন কংগ্রেসের লড়াই ছিল বামেদের সঙ্গে। কিন্তু এবার তৃণমূল রয়েছে। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর এই লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে বলে দাবি তৃণমূল শিবিরের। যদিও কংগ্রেস ও বামেদের দাবি, মুর্শিদাবাদে তৃণমূল তিন নম্বরেই থাকবে।

তৃণমূল প্রার্থী মহম্মদ আলি হাসতে হাসতেই বলছেন, “তৃণমূল তিন থেকেই শুরু করেছিল। এখন অবশ্য এক নম্বরে। এখানেও আমরা তিন থেকে একে চলে আসব।”

মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপির নির্বাচনি এজেন্ট শাখারব সরকার বলছেন, “কে কোন নম্বরে থাকবে তা নিয়ে আমরা ভাবছি না। আমাদের প্রার্থী সুজিতকুমার ঘোষ প্রাক্তন আইপিএস। একসময় মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপারও ছিলেন। ফলে এলাকা সম্পর্কে তাঁরও অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর রয়েছে মোদী হাওয়া। ফলে পাটিগণিতের সব অঙ্ক নাও মিলতে পারে।”

অঙ্ক না মেলার পুরনো অভিজ্ঞতা রয়েছে বামেদেরও। ২০০৯ সালের লোকসভায় প্রার্থী ছিলেন খোদ আনিসুর। নিজের জয়ের ব্যাপারে একপ্রকার নিশ্চিতও ছিলেন। কিন্তু মানুষ রায় দিয়েছিলেন মান্নানের পক্ষে। তাই এবারে কর্মী সমর্থকদের প্রতি তাঁর বার্তা, “আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। আরও পরিশ্রম করতে হবে।” কাঠফাটা রোদ্দুরে মেঠো পথে প্রার্থীকে নিয়ে এগিয়ে চলে আনিসুরের গাড়ি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন