কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে টিএমসিপি-র মোটরবাইক মিছিল। ডান দিকে, শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকের পরে উচ্ছ্বাস বিএড কলেজের পড়ুয়াদের। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী! সংবাদমাধ্যমের দৌলতে খবরটা রটে গিয়েছিল মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেই। সেই মতো প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। বুধবার সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বেসরকারি বিএড কলেজের হাজারখানেক পড়ুয়া। তাঁদের সঙ্গে চলে এসেছিলেন ওই কলেজের মালিকরাও। পিছিয়ে ছিলেন না জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীরাও। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে স্নাতক স্তরের পার্ট ১ এর রেজাল্ট। বহু ছাত্রছাত্রীরই রেজাল্ট অসম্পূর্ণ রয়েছে। বারবার বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। মন্ত্রী আসছেন শুনে কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ করে এ দিন সকালে ওই অসম্পূর্ণ রেজাল্ট প্রকাশের প্রতিবাদে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই মোটরবাইক মিছিল করল টিএমসিপি।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রতনলাল হাংলু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের পরিবেশ নষ্ট করছেন। তাঁর নানা নিয়মের গেরোয় দমবন্ধ হয়ে আসছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী থেকে শুরু করে শিক্ষক ও আধিকারিকদের একাংশের। এমনই নানা অভিযোগ তুলে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মিছিল বের করেন অধ্যাপক, আধিকারিক, শিক্ষাকর্মী, গবেষক, ছাত্রছাত্রী ও শুভানুধ্যায়ীরা। স্থানীয় সূত্রে খবর ওই মিছিলে যোগ দেওয়া প্রায় সকলেই তৃণমূলেরই লোকজন বলে পরিচিত। পরবর্তীতে ওই মিছিলে যোগ দেন সারা বাংলা তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতির সদস্যরা। সেই মিছিলের বেশ কিছু সদস্য বিক্ষোভের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমতো তাণ্ডব চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ প্রতাপকুমার সাঁতরাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। মাঝবয়সী এক মহিলা প্রতাপবাবুকে যে ভাবে কিল, চড়, ঘুসি মেরেছেন সেই দৃশ্য সংবাদমাধ্যমের দৌলতে প্রায় সকলেই দেখেছেন।
সেই অবস্থায় উপাচার্য রতনলাল হাংলু গোটা বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন রাজ্যপাল ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে। সেই কারণেই বুধবার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দুপুর একটা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে থামে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গাড়ি। সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএড কলেজের হাজারখানেক পড়ুয়া। তাঁরা মন্ত্রীকে ঘিরে ধরে রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। ঠিক তখনই ছুটে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী ও শিক্ষাবন্ধু সমিতির সদস্যরা। তাঁরাই মন্ত্রীকে রীতিমতো আগলে নিয়ে যান উপাচার্যের ঘরের দিকে। উপাচার্য তখন তাঁর ঘরের সামনে ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই তোড়া মন্ত্রীর হাতে দিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যান উপাচার্য। তাঁর ঘরেই দুপুর দেড়টা থেকে দুপুর সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত দফায় দফায় আলোচনা চলে।
সেই আলোচনার শেষেও নানা নাটকের সাক্ষী থাকল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। মঙ্গলবার উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে শিক্ষাবন্ধু সমিতির যাঁরা বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন, বুধবার তাঁরাই পার্থবাবুকে সংবর্ধনা দিলেন। হাসিমুখে ছবি তুললেন। এবং বৈঠকের পরে জানালেন, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তাঁরা প্রত্যাহার করলেন। সারা বাংলা তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতির সভাপতি দেবব্রত সরকার বলেন, “আমরা উপাচার্যের যে পদত্যাগ দাবি করেছিলাম তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। গতকালের ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা করছি। ওই মহিলার সঙ্গে আমাদের কোনওরকম সম্পর্ক নেই। সিপিএম, বিজেপি ষড়যন্ত্র করে আমাদের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। প্রতাপকুমার সাঁতরার সঙ্গে ওই মহিলার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে যদি কোনও গণ্ডগোল হয়ে থাকে সেটা আমাদের জানা নেই।” তবে প্রতাপবাবুর সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। মঙ্গলবার সুজাতা চৌধুরী নামে যে অধ্যাপিকাকে নিগ্রহ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ, সেই সুজাতাদেবী এ দিন বলেছেন, “আমি মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় ছিলাম। কিন্তু উপাচার্য আমাদের বলেছেন সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ না খুলতে। যা বলার উপাচার্যই বলবেন।”
পার্থবাবু আসার আগে বুধবার সকালেও উপাচার্য রতনলাল হাংলু সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, “রাজ্য সরকার চাইলে আমি পদত্যাগ করব।” মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরে সেই উপাচার্যের বক্তব্য, “এ দিনের আলোচনায় আমিও খুশি, সন্তুষ্ট। পদত্যাগ করার প্রশ্নই আসছে না। দু-একটি বিষয় নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা হবে। যে মহিলা প্রতাপ সাঁতরাকে মারধর করেছিল তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গতকাল যে শিক্ষাবন্ধুরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসে করে কল্যাণীতে এসে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? উত্তরে পার্থবাবু বলেন, “এই বিষয়টি সংবাদমাধ্যম ঠিক করবে না।” পার্থবাবু জানান, এখানকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিই বিষয়গুলি দেখবে। এখানকার ভর্তি ফি বেশি হয়ে গিয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামীণ এলাকা থেকে পড়ুয়ারা আসেন। তাই এখানকার ভর্তি ফি কমানোর কথা তিনি বলেছেন। বিএড কলেজ নিয়ে এনসিটিই ২০০৯ নিয়ম অনুযায়ী পড়ুয়াদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকেও তিনি বলেছেন। তবে নিয়মের বাইরে অর্থাৎ কলেজ পিছু ১০০ জনের বেশি কেউ ভর্তি হলে তাদের দায়িত্ব নেওয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যও রয়েছে। সেগুলো প্রচার করা হচ্ছে না।
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সম্পাদক প্রসেনজিৎ মণ্ডল বলেন, “আমাদের দাবি মেনে নিয়ে ভর্তি ফি কমানো হয়েছে। সুন্দর ক্যান্টিন ব্যবস্থা ও অসম্পূর্ণ ফল প্রকাশেরও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এ দিনের আলোচনায় আমরা খুশি।” এ দিনের আলোচনায় খুশি বিএড কলেজের মালিক ও পড়ুয়ারাও।