সজল ঘোষ হত্যা মামলা

দিনভর পঙ্কজের সর্বময় উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন

কেউ সওয়াল করলেন, ঘটনাস্থলে থাকলেও সাক্ষী হিসেবে সবাইকে ডাকা হয়নি। আবার সাক্ষীদের জবানবন্দি, নথিপত্র উল্লেখ করে কেউ দেখালেন মামলা প্রতি ঘটনা জুড়ে একজনের বিশেষ উপস্থিতি। মঙ্গলবার সজল ঘোষ হত্যা মামলার ষষ্ঠ দিনের শুনানিতে এমনই চাপানউতোর চলল দুপুর পর্যন্ত। এ দিন নবদ্বীপের অতিরিক্ত এবং সেশন জজ সুধীর কুমারের আদালতে অভিযুক্ত পক্ষের তিন আইনজীবী সওয়াল করেন।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৪ ০২:০৯
Share:

কেউ সওয়াল করলেন, ঘটনাস্থলে থাকলেও সাক্ষী হিসেবে সবাইকে ডাকা হয়নি। আবার সাক্ষীদের জবানবন্দি, নথিপত্র উল্লেখ করে কেউ দেখালেন মামলা প্রতি ঘটনা জুড়ে একজনের বিশেষ উপস্থিতি। মঙ্গলবার সজল ঘোষ হত্যা মামলার ষষ্ঠ দিনের শুনানিতে এমনই চাপানউতোর চলল দুপুর পর্যন্ত।

Advertisement

এ দিন নবদ্বীপের অতিরিক্ত এবং সেশন জজ সুধীর কুমারের আদালতে অভিযুক্ত পক্ষের তিন আইনজীবী সওয়াল করেন। কাঠগড়ায় কখনও স্থির দাঁড়িয়ে, কখনও পায়চারি করতে দেখা গেল মামলার অন্যতম অভিযুক্ত প্রদীপ সাহাকেও।

শুরুতেই প্রদীপ সাহার আইনজীবী প্রতিম সিংহ রায় সওয়াল করেন যে মামলার তদন্তকারী অফিসার বিভাস সেন তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন এই মামলায় প্রয়োজনীয় সাক্ষীর অভাব নেই। অথচ ওই রাতে নবদ্বীপ হাসপাতালে ঘটনাস্থলে এমন অনেক ব্যক্তির উপস্থিতির কথা জানা গিয়েছে, যাঁদের সাক্ষী হিসেবে ডাকা হয়নি। তেমন কয়েকজনের মধ্যে বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়, তাঁর গাড়ির চালক, নিরাপত্তারক্ষী, গৌতম ভট্টাচার্য, নিমাই মিত্র প্রমুখের নাম করেন তিনি। প্রতিমবাবুর দাবি, এদের কয়েকজনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদও করেছে, অথচ মামলার সাক্ষী করা হয়নি।

Advertisement

ওই রাতে প্রদীপ সাহাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল রাত ৩.৩৫ মিনিটে। আইন অনুযায়ী কাউকে গ্রেফতার করার সময়ে গ্রেফতারি মেমোতে ধৃতের পরিবারের কেউ অথবা এলাকার বিশিষ্ট কারও সই করার কথা। প্রদীপবাবুর ক্ষেত্রে সই রয়েছে নারায়ণ চক্রবর্তীর। অথচ তদন্তকারী অফিসার বলতেই পারেননি নারায়ণ চক্রবর্তী কে। ওই মেমোতে তিনি কী হিসেবে সই করেছেন তাও বলতে পারেননি তিনি।

এরপরে সওয়াল করতে ওঠেন আর এক আইনজীবী সামসুল ইসলাম মোল্লা। তাঁর দাবি, মামলার প্রতি ক্ষেত্রে একজনকে বিশেষ সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। তিনি হলেন, এক নম্বর সাক্ষী তথা পূর্বস্থলীর প্রধান পঙ্কজ গঙ্গোপাধ্যায়। মামলার বিভিন্ন নথি, সাক্ষীদের জেরা, জবানবন্দি থেকে সামসুল মোল্লা দেখান, ঘটনার দিন কলেজে গোলমালের সময়, সন্ধ্যায় পার্টি অফিসে, রাতে হাসপাতালে, সজল ঘোষ গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়ে এমনকী আহত সজলবাবুকে ভর্তি করানোর সময়েই পঙ্কজবাবু ছিলেন। সজল ঘোষের সুরতহাল রিপোর্টে, পুলিশের সিজার লিস্টেও তাঁর স্বাক্ষর রয়েছে। সামসুল মোল্লার দাবি, দেখা যাচ্ছে মামলার ২, ৪, ৫ এবং ৬ নম্বর সাক্ষীকে ২১-০১-১২ তারিখে থানায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্যও নিয়ে গিয়েছিলেন পঙ্কজবাবু। এফআইআরও তিনিই করেন। অথচ সজল ঘোষের স্ত্রী, বাবা-মা বা পরিবারের কাউকে এত বড় ঘটনায় এতখানি সক্রিয় ভাবে দেখা যায়নি। অথচ ওই মামলার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী সৌভিক আইচের কথা অনুযায়ী, পঙ্কজবাবুকে দেখা গিয়েছিল সুরতহালের পরে।

সামসুল মোল্লা বলেন, মনে রাখতে হবে পঙ্কজবাবু কিন্তু সাধারণ ব্যক্তি নন। তিনি পূর্বস্থলীর বর্তমান প্রধান দলের একজন গুরত্বপূর্ণ পদাধিকারী। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উল্লেখ করে সামসুল মোল্লা বলেন, এ ধরনের ‘বিশেষ আগ্রহী’দের বিশ্বাস করা যায় না। এরপরেই তথ্য গোপনের অভিযোগ আনেন তিনি। তিনি বলেন, ঘটনার পরে নবদ্বীপ হাসপাতালে উপস্থিত বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় প্রথম ফোন করেন পূর্বস্থলী থানায়। পূর্বস্থলী থানা থেকে তা জানানো হয় নবদ্বীপ থানাকে। সামসুল মোল্লার প্রশ্ন, বিধায়ক হিসেবে তপনবাবু কি জানতেন না পূর্বস্থলী থানা এলাকায় নবদ্বীপ হাসপাতাল পড়ে না? এছাড়া কলেজে গোলমালের ভিত্তিতে পূর্বস্থলী থানায় সেদিন প্রথম যে এফআইআরটি করা হয়েছিল সেটিও আদালতে পেশ করা হয়নি বলে উল্লেখ তরেন তিনি। তাঁর দাবি, এ থেকেই স্পষ্ট কিছু গোপন করার চেষ্টা চলছে।

এ দিন শেষ সওয়াল করেন আইনজীবী বিষ্ণুপ্রসাদ শীল। তাঁর দাবি, সজল ঘোষ খুনের ‘মোটিভ’ পরিস্কার নয়। কারণ প্রদীপবাবু একজন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, ডবল এম এ, বিধানসভায় সিপিএমের দলীয় প্রার্থী এবং জোনাল কমিটির সম্পাদক। তার সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে নিহত সজল ঘোষের কোন তুলনাই হয় না। তাছাড়া সজলবাবু কিংবা প্রদীপ সাহা কেউই পূর্বস্থলী কলেজের পড়ুয়া নন, যে ছাত্র সংসদের নিয়ে রেষারেষি থাকবে। তাঁর প্রশ্ন, ঘটনাস্থলে আরও বড় বড় মাপের নেতারা উপস্থিত সজল ঘোষকে প্রদীপবাবু কেন খুন করতে যাবেন? তিনি বলেন, খুনের অভিযোগ কষ্টকল্পিত। বিষ্ণুবাবু আরও বলেন, মামলার তদন্তকারী অফিসার বলেছেন প্রদীপবাবুকে রাত ৩.৩৫ মিনিটে গ্রেফতার করা হয়। অথচ অন্য একটি জিডি থেকে জানা যাচ্ছে রাত ২.১৫ মিনিটে তাঁকে ধুবুলিয়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয় নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্য। আইনজীবীর যুক্তি, তার মানে প্রদীপবাবুকে অনেক আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। বিষ্ণবাবুর পরের সওয়াল, সাক্ষীরা বলেছেন প্রদীপবাবু পিছন থেকে সজল ঘোষকে জড়িয়ে ধরেন এবং লোকনাথ খুব কাছ থেকে তার বুকে গুলি করে। কিন্তু এক্ষেত্রে গুলি প্রথম ব্যক্তিকে ভেদ করে যিনি জড়িয়ে ধরেছেন তাকেও ফুঁড়ে দিতে পারে। বিজ্ঞানের ছাত্র প্রদীপ সাহা এটা জানতেন না ভাবার কোনও কারণ নেই। তাছাড়া গুলিটি সজলবাবুর দেহও ভেদ করতে পারেনি। পরে ময়না-তদন্তের সময় তা বের করা হয়। তাঁর দাবি, সরকার পক্ষ যে ভাবে একটি মিথ্যা খুনের গল্প লিখতে চেয়েছিলেন তাতে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।

বুধবার আবারও ওই মামলার শুনানি হওয়ায় কথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন