দোল পূর্ণিমায় লক্ষ্মীলাভের আশায় বুক বাঁধছেন নবদ্বীপের ব্যবসায়ীরা

নবদ্বীপে এখন উৎসবে বসতি লক্ষ্মী। তেরো পার্বণের শহর নবদ্বীপ। পার্বণ নিয়েই বাঁচে হাজার বছরের প্রাচীন এই জনপদ। এই শহরের ভাল-মন্দের সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক নিবিড়। বৈশাখ থেকে চৈত্র নবদ্বীপের উৎসব ক্যালেন্ডারে কোনও না কোনও উৎসব লেগেই আছে। শিল্প কারখানাহীন এই শহরের অর্থনীতি ভীষণ ভাবেই উৎসব এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত পর্যটনের উপর নির্ভরশীল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৫ ০১:০৪
Share:

দোলের বিকিকিনি।—নিজস্ব চিত্র।

নবদ্বীপে এখন উৎসবে বসতি লক্ষ্মী। তেরো পার্বণের শহর নবদ্বীপ। পার্বণ নিয়েই বাঁচে হাজার বছরের প্রাচীন এই জনপদ। এই শহরের ভাল-মন্দের সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক নিবিড়।

Advertisement

বৈশাখ থেকে চৈত্র নবদ্বীপের উৎসব ক্যালেন্ডারে কোনও না কোনও উৎসব লেগেই আছে। শিল্প কারখানাহীন এই শহরের অর্থনীতি ভীষণ ভাবেই উৎসব এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই তেরো পার্বণের মধ্যে অন্যতম প্রধান পার্বণ কোনটি, রাস নাকি দোল? নবদ্বীপের মুখ্য দুই উৎসবকে নিয়ে এ বিতর্ক নতুন নয়। তবে যত দিন যাচ্ছে ধারে এবং ভারে দোল যেন রাস উৎসবকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে।

বাণিজ্য থেকে সংস্কৃতি সর্বস্তরেই দোল এখানে আন্তর্জাতিক মহিমা সমৃদ্ধ। নবদ্বীপ-মায়াপুরের দোল সারা দেশ জুড়ে প্রচলিত শ্রীকৃষ্ণের হোলি বা রঙের উৎসব নয়। ৫৩০ বছর আগে এই দোল পূর্ণিমাতেই নবদ্বীপে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব হয়েছিল। বৈষ্ণব ভক্তরা দোল পূর্ণিমাকে এখানে গৌর পূর্ণিমায় বদলে দিয়েছেন। গঙ্গার পূর্ব-পশ্চিম দুই পাড়ে দোল উৎসবের উদযাপনও তাই স্বতন্ত্র ভাবে হয়। আর সেই ভিন্ন মাত্রার দোল উৎসবে সামিল হতে সারা পৃথিবী ছুটে আসে চৈতন্যস্মৃতি বিজড়িত নবদ্বীপে।

Advertisement

একদিকে পৃথিবীর শতাধিক দেশের কয়েক হাজার বিদেশি পর্যটক। অন্য দিকে, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ। প্রায় এক মাস ধরে তাদের আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার সুবাদে নবদ্বীপের ব্যবসা বাণিজ্যে লক্ষীলাভের ইঙ্গিত স্পষ্ট। স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল সাফ জানাচ্ছে, কোন সন্দেহ নেই নবদ্বীপের সেরা বাণিজ্য মরসুম এখন দোল এবং তা সবদিক থেকে ছাপিয়ে গিয়েছে শহরের আর এক বড় উৎসব রাসকে।

চৈতন্যধাম নবদ্বীপের দোলের চরিত্র যতই আন্তর্জাতিক হচ্ছে, ততই ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দোল স্থানীয় অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে। লক্ষাধিক দেশি বিদেশি পর্যটকের কমবেশি পনেরো দিন ধরে নবদ্বীপে থাকা খাওয়া এবং পর্যাপ্ত কেনাকাটার ফলে শহরের সব ধরনের ব্যবসা উল্লেখযোগ্য ভাবে উপকৃত হয়েছে। একটা সময় পর্যন্ত নবদ্বীপের প্রধান উৎসব বলে পরিচিত রাসের থেকে দোলের মরসুমে দ্বিগুণেরও বেশি বাণিজ্য হয় বলে জানিয়েছেন নবদ্বীপের ব্যবসায়ীরা। নবদ্বীপের দোল ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। একটা সময়ে দোলের উৎসব কেবল গঙ্গার পূর্ব পাড়ে মায়াপুরের ইস্কনের চত্বরেই সীমাবদ্ধ থাকত। সামান্য কিছু উৎসাহী মানুষ যেতেন ‘সাহেব মঠের’ সেই দোল দেখতে।

কিন্তু এখন উৎসবের হাওয়া গতিপথ বদলে গঙ্গার পশ্চিম পাড় বরাবর বইছে। ফলে ছবিটা বেবাক বদলে গিয়েছে। মায়াপুরকে বাদ দিয়ে নবদ্বীপের দোলও একটা স্বতন্ত্র চরিত্র লাভ করেছে। গত দেড় দশক ধরে একটু একটু করে পৃথিবীতে পরিচিতি পেয়েছে এই জনপদ। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেবদাস দত্তের কথায়, “যত দিন যাবে ততই নবদ্বীপের দোলের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। যার ফসল ঘরে তুলতে পারবেন নবদ্বীপের সব শ্রেণির ব্যবসায়ী।”

ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্তারা যে ভুল কিছু বলেননি তার প্রমাণ মিলেছে শহরের বিভিন্ন মঠমন্দির এবং পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে। স্থানীয় নবদ্বীপ জলপথ পরিবহণ সমবায় সমিতির দেওয়া খেয়াঘাটের টিকিট বিক্রির হিসাব থেকে জানা গিয়েছে গত বছর শুধু দোলের দিন প্রায় ৯৬ হাজার ৪০০ লোক পারাপার করেছেন। কার পার্কিংয়ে প্রায় ১৭০০ গাড়ি ছিল। এ ছাড়া ট্রেন, বাসে হাজার হাজার মানুষ এসেছেন, খেয়েছেন এবং থেকেছেন। মায়াপুর ইস্কনের রমেশ দাস জানিয়েছেন, সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার বিদেশি এসেছেন। তাঁরা ১২ দিন ধরে ৭২ কিলোমিটার নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমা করেছেন। নবদ্বীপের কেশবজী গৌড়ীয় মঠের মধুসূদন দাস জানিয়েছেন দু’হাজারের বিদেশি এখন পরিক্রমা করছেন। সঙ্গে প্রায় ১৮ হাজার ভারতীয় ভক্ত। নবদ্বীপের প্রধান কয়েকটি মঠ যেমন দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ, চৈতন্য সারস্বত মঠ, জন্মস্থান আশ্রম মিলিয়ে কমবেশি ৫০ হাজার ভক্ত গত পনেরো দিন ধরে শহরে বাস করেছেন। নবদ্বীপ এবং সংলগ্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে পরিক্রমা করেছেন। এছাড়াও নবদ্বীপে ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় শ’দেড়েক মঠমন্দির রয়েছে। এর প্রতিটিতেই দোলের পরিক্রমা করতে ভক্তরা এসেছেন। বিদেশিরা খাওয়াদাওয়া কেনাকাটা করার জন্য ডলার ভাঙিয়েছেন টাকায়। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাসের কথায়, “দোলের পনেরো দিন এই শহরে লক্ষাধিক বহিরাগতের আসা যাওয়া। তার প্রভাব স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্যের উপর পড়তে বাধ্য। এ বার খুব ভাল ব্যবসা হয়েছে।” নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সম্পাদক গোকুলবিহারী দাস বলেন, “প্রতিবারই তার আগের বারকে টেক্কা দেওয়া দোলের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে।”

মুদিখানা থেকে সব্জি, মিষ্টি-ফল থেকে শুকনো খাবার, বোতলে ভরা পানীয় জল থেকে ডাব, নিম্বুপানি কিম্বা টুপি, রোদচশমা থেকে সাধারণ সুতির জামাকাপড় এমনকী আয়ুর্বেদিক ওষুধ সব কিছুরই ভালই বিকিকিনি চলছে শহরের সর্বত্র। নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “নবদ্বীপের সব মঠমন্দির মিলিয়ে লক্ষাধিক ভক্ত তিন বেলা প্রসাদ পেয়ে থাকেন। তাদের জ্বালানী থেকে শুরু করে সবই স্থানীয় বাজার থেকেই কেনা হয়। তার প্রভাব স্থানীয় বাজারে পড়বেই।” শুধু প্রয়োজনের জিনিসই নয়, বিশ্বের মানুষ দোলে এখানে আসেন মহাপ্রভুকে স্মরণ করতে। এরা ফেরার পথে কিছু স্মারক যেমন নিয়ে যেতে চান তেমনি নবদ্বীপের অতীত ঐতিহ্যের কাঁসার বাসনপত্র, তাঁতের শাড়ি স্বাভাবিক ভাবেই কিনতে চান। বাদ যায় না গৃহদেবতার পোশাক, গয়নাও। দোল ঘিরে নবদ্বীপের ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা বাড়াচ্ছে। তাঁদের মতে রাসে যেখানে মানুষ শুধুই হুল্লোড় করতে আসেন সেখানে দোলের নবদ্বীপে এখন উৎসবে বসতে লক্ষ্মী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন