ব্যস্ততা কৃষ্ণনগর পালপাড়ায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
শিলিগুড়ি থেকে শ্যামবাজার। দমদম থেকে দুর্গাপুর। শারদোৎসবের মণ্ডপ জুড়ে ছড়িয়ে থাকে ওঁদের তৈরি চোখ জুড়োনো প্রতিমা। সারা বাংলার মানুষ বছরভর অপেক্ষায় থাকেন তার জন্য। তাই উদ্যোক্তারাও বৈশাখ মাস পড়তে না পড়তেই ছুটে আসেন বায়নার টাকা হাতে নিয়ে। সবার আগে কৃষ্ণনগরের প্রতিমা চাই। কেউ ছোটেন ঘূর্ণি কেউ বা কৃষ্ণনগর নতুনবাজারের পাল পাড়ায়। সুবীর পাল, রাজীব পাল, কানাই ঘোষ, সুরজিৎ ঘোষ, জয়ন্ত পাল বা সুদীপ্ত পালের কাছে। বায়না পাকা করার পর তবে অন্য কথা। কিন্তু এবার সব গুণমুগ্ধকে পাকা কথা দিতে পারেনি ঘূর্ণি বা কৃষ্ণনগর পালপাড়া। মন খারাপ করে প্রতিমার খোঁজে অন্যত্র যেতে হয়েছে বহু উদ্যোক্তাকে। কিন্তু কেন? কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা জানিয়েছেন, দক্ষ শ্রমিকের অভাবে বাধ্য হয়ে এবার দুর্গাপুজোয় কম প্রতিমা গড়ছেন। সুনামের সঙ্গে তো আর আপোস করা যায় না।
কৃষ্ণনগরের আনন্দময়ীতলা সংলগ্ন নতুনবাজার পরিচিত নাম পাল পাড়া। অলিগলি জুড়ে ছড়ানো মৃৎশিল্পীদের কারখানা। বছরের এই সময়টায় ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরি হচ্ছে অসামান্য এক একটি দুর্গাপ্রতিমা। মহালয়ার পর থেকেই উদ্যোক্তারা প্রতিমা নিতে চলে আসবেন। তাই সকাল থেকে রাত শিল্পী কারিগর শ্রমিক সবাই মিলে প্রতিমা নির্মাণের চূড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতিতে ডুবে আছেন। চারদিকে সাজানো বিশালাকায় অর্ধসমাপ্ত সব প্রতিমার সারির মাঝে হাত দু’য়েক চওড়া জায়গা। অনেকটা গলি রাস্তার মতো। আত্মমগ্ন শিল্পীরা দ্রুত হাতে প্রতিমার রূপটানে ব্যস্ত। নিখুঁত অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠছে দেবীপ্রতিমার কমনীয় মুখ কিংবা মহিষাসুরের পেশিবহুল দেহ।
এমন প্রতিমাময় গলি দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ ছন্দপতন। পরপর কয়েকটি প্রতিমা গড়ার বাঁশের বন্ধ্যা কাঠামো। বাঁধা হয়নি খড়, পড়েনি মাটির প্রলেপ। বাজারে কৃষ্ণনগরের প্রতিমার তুমুল চাহিদা সত্ত্বেও এ বার ওই কাঠামোয় গড়া হবে না কোনও নয়ন ভোলানো প্রতিমা। কেবল মাত্র উপযুক্ত শ্রমিক, কারিগরের অভাবে ফাঁকাই পরে আছে ওইসব প্রতিমার কাঠামো। আর এটা কোনও একটি মৃৎ শিল্পাগারের বিছিন্ন ছবি নয়। ঘূর্ণি বা কৃষ্ণনগরের বেশির ভাগ পালবাড়িতে কমবেশি এমন ঘটনা ঘটেছে।
শিল্পীদের বক্তব্য, গত কয়েকবছর ধরেই পুজোর মরশুমে শ্রমিক নিয়ে সমস্যায় পড়ছিলেন তাঁরা। বায়না নেওয়া প্রতিমা নিজেদের সুনাম বজায় রেখে তৈরি করা মুশকিল হয়ে পড়ছিল। এবার তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে কমিয়ে দিয়েছেন প্রতিমার সংখ্যা। নিরুপায় হয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তাদের।
বংশ পরম্পরায় প্রতিমা গড়ে বিখ্যাত ঘূর্ণি-কৃষ্ণনগরের মৃৎ শিল্পীরা। সেই কবে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বাংলাদেশের নাটোর থেকে মৃৎশিল্পীদের আনিয়ে ছিলেন। তারপর আড়াইশো বছর ধরে একটু একটু তাঁদের শাখা-প্রশাখা নদিয়া ছাড়িয়ে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কী কলকাতা কুমোরটুলির মৃৎশিল্পের শিকড় সেই রাজশাহির জেলার নাটোর থেকেই উৎসারিত। অবশ্য সকলে এ বিষয়ে একমত নন। ১৮৭৪ সালে দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ের লেখা ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’ থেকে নদিয়ায় মৃৎশিল্পের উদ্ভব এবং বিকাশে রাজবাড়ির বিশেষ ভুমিকার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এর সাড়ে তিন দশক পরে নদিয়া জেলার উপর এর এক প্রামাণ্য বই ‘নদিয়া কাহিনীর’ লেখক কুমুদনাথ মল্লিক অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর মতে, কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা কুম্ভকার। সূচনায় তাঁরা ছিলেন কুমোর এবং দেবদেবীর প্রতিমা নির্মাতা। পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণনগরের মিশনারি এবং শিল্প সমঝদার ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের বিকাশ ঘটে। নদিয়ারাজ পরিবার প্রবর্তিত বিভিন্ন পুজো উসবে নানা মূর্তি তৈরি করতে তৎকালীন মৃৎশিল্পীরা। সসম্মানে ডাক পেলেও তাঁদের সমৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন বিদেশিরাই।
এ নিয়ে মত পার্থক্য যাই থাকুক না কেন কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের আন্তর্জাতিক সম্মান পাওয়া শুরু ১৮৫১ সালে। লন্ডনের এক প্রদর্শনীতে ঘূর্ণির শ্রীরাম পালের মৃৎশিল্প স্থান পায় এবং প্রথম সুযোগেই বিশ্ব জয় করে। তারপর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
তাই যে কোনও পুজোতেই কৃষ্ণনগরের প্রতিমার বিরাট চাহিদা। কিন্তু সেই চাহিদা সামাল দিতে এখন রীতিমতো নাজেহাল পাল পাড়া। গত বছরেও ৩২টি দুর্গাপ্রতিমা গড়েছিলেন রাজীব পাল। এ বছরে সংখ্যাটি কমে ২৭। কানাই ঘোষ গড়েছিলেন ৪৪টি প্রতিমা। এবছরে মাত্র ৩৫টি প্রতিমার বায়না নিয়েছেন। কেন কমালেন প্রতিমার সংখ্যা? প্রশ্ন করতেই তিন পুরুষের শিল্পী রাজীব পাল পাল্টা বলেন, “তৈরি করবে কে? লোক কোথায়? আজকাল তো কেউ আর চট করে এসব কাজ করতে আসতে চায় না। যাঁরা এ কাজ করেন তাঁদের অনেকেই এখন ভিন্ রাজ্যে। ওখানে কাজে অনেক বেশি টাকা। এখানে দক্ষতা অনুযায়ী শ্রমিকেরা ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। অন্য রাজ্যে কাজে গিয়ে তাঁরা অনেক বেশি উপার্জন করেন। দক্ষ অদক্ষ সব ধরনের লোক সেখানেও দরকার। ফলে প্রচুর মানুষ চলে যাচ্ছেন। আমরা কাজের জন্য লোক পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে প্রতিমার সংখ্যা কমাচ্ছি। যাতে প্রতিমার গুণগত মানের কোনও খামতি না থাকে।”
প্রায় একই কথা বললেন কানাই ঘোষ। তিনি এবং তাঁর ছেলে সুরজিৎ মিলে এবার ৩৫টি প্রতিমা তৈরি করছেন। সুবিখ্যাত শিল্পী সুবল পালের কাছে ১২ বছর বয়স থেকে একটানা ৩৫ বছর কাজ করার পর এখন নিজেই প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। তিনি জানান, এই সময়ের সব থেকে বড় সঙ্কট হল মাটি মেখে জীবিকা উপার্জন করতে শিল্পীদের ঘরের ছেলেরাই আগ্রহী নয়। তাহলে অন্য পেশার মানুষ এখানে কেন আসবে? তাছাড়া সারা বছর তো কাজের সমান চাপ থাকে না। তখন কী করে দিন চলবে? এইসব অনিশ্চয়তার কারণে এমনিতেই লোক কমে যাচ্ছে। তারপর এখন বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নানা ধরনের কাজে প্রচুর টাকা। ফলে লোকে চলে যাচ্ছেন। নিরুপায় হয়ে কাজের পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন শিল্পীরা।
ঘূর্ণির শিল্পী সুদীপ্ত পাল বলেন, “ঘূর্ণি থেকে প্রতিমার বদলে উদ্যোক্তারা এখন সরাসরি শিল্পীদের নিয়ে যেতে চান। কেননা ঘূর্ণি থেকে যে পথ দিয়ে ঠাকুর নিয়ে যেতে হয় সে পথের অবস্থা খুব খারাপ। ফলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিমা যখন দূরদুরান্তের মণ্ডপে পৌঁছয় তখন প্রচুর মেরামত করতে হয়। লোকে সে কারণেও পিছিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে প্রতিমা নিয়ে যেতে। সব মিলিয়ে প্রতিমার সংখ্যা কমছেই।”