নামের ফেরে খুনের মামলায় ফেঁসে গারদে ১২ বছর

‘সবার উপরে’ ছবিতে মিথ্যে মামলায় এক যুগ জেল খাটার পরে খালাস পেয়ে ছবি বিশ্বাসের আর্তি ছিল, ফিরিয়ে দাও আমার ১২টা বছর! একই সংলাপ বেরিয়ে আসতে পারে নদিয়ার দিলীপ তরফদারের মুখ থেকে। দিলীপের মামলা বেশি মর্মান্তিক। কারণ, ছবিবাবু অভিনীত চরিত্রটির মতো তাঁর বিষয়টি পর্দার চিত্রনাট্য নয়, কঠোর বাস্তব। আপাতদৃষ্টিতে দিলীপ ফেঁসে গিয়েছিলেন নাম-বিভ্রাটে। নামে, বিশেষ করে নামের মিলে যে অনেক কিছুই আসে-যায়, হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গিয়েছেন তিনি!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:৩২
Share:

‘সবার উপরে’ ছবিতে মিথ্যে মামলায় এক যুগ জেল খাটার পরে খালাস পেয়ে ছবি বিশ্বাসের আর্তি ছিল, ফিরিয়ে দাও আমার ১২টা বছর! একই সংলাপ বেরিয়ে আসতে পারে নদিয়ার দিলীপ তরফদারের মুখ থেকে। দিলীপের মামলা বেশি মর্মান্তিক। কারণ, ছবিবাবু অভিনীত চরিত্রটির মতো তাঁর বিষয়টি পর্দার চিত্রনাট্য নয়, কঠোর বাস্তব।

Advertisement

আপাতদৃষ্টিতে দিলীপ ফেঁসে গিয়েছিলেন নাম-বিভ্রাটে। নামে, বিশেষ করে নামের মিলে যে অনেক কিছুই আসে-যায়, হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গিয়েছেন তিনি! নাম-সাদৃশ্যের ফাঁদে পড়ে দীর্ঘ ১২ বছর জেল খাটার পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত রেহাই পেয়েছেন তিনি।

ঘটনাচক্রে ‘সবার উপরে’ এবং দিলীপের মামলা একই আদালতের। কৃষ্ণনগর আদালত। নদিয়ার তেহট্টে একটি খুনের মামলায় অন্যতম অভিযুক্তের নাম ছিল দিলীপ মণ্ডল। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার না-করে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল দিলীপ তরফদার নামে এক যুবককে। সেই হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত করে তরফদার দিলীপ-সহ তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় কৃষ্ণনগর আদালত। ১২ বছর পরে, বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নিশীথা মাত্রে ও বিচারপতি সমাপ্তি চট্টোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ তিন জনকে বেকসুর মুক্তি দিয়েছে। সরকারি আইনজীবী মধুসূদন শূর জানান, দণ্ডিত তিন জনের মধ্যে মনোজ মণ্ডল ২০০৬ সালে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন। তা মঞ্জুরও হয়েছিল।

Advertisement

বিভ্রাট ঠিক কোথায়?

পুলিশ জানায়, ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তেহট্ট থানা এলাকার সাহেবনগর গ্রামে সুখদেব মণ্ডল (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তাঁর দাদা মদন মণ্ডল থানায় খুনের অভিযোগ করেন। মাসখানেক পরে ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে দিলীপ তরফদার, মহীতোষ মণ্ডল, মনোজ মণ্ডল-সহ আট জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কৃষ্ণনগর আদালতের অতিরিক্ত জেলা দায়রা বিচারক ২০০৫ সালে তরফদার দিলীপ, মহীতোষ ও মনোজকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। প্রমাণের অভাবে পাঁচ জন মুক্তি পান।

দিলীপের আইনজীবী সুবীর দেবনাথ জানান, ২০০৬ সালে তাঁর মক্কেল এবং দণ্ডিত অন্য দুই যুবক নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন। মামলার আবেদনে পুলিশি তদন্তের ফাঁক হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা হয়। তার মধ্যে ছিল: l তদন্তকারী জানিয়েছেন, সুখদেব গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন। গুলি বুকে লেগে পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বলে জানাচ্ছে ময়না-তদন্ত। অথচ মৃত্যুর সময় সুখদেবের পরনের যে-জামা নিম্ন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছিল, তাতে গুলির কোনও চিহ্নই ছিল না। l আবেদনে আরও বলা হয়, আক্রান্ত ব্যক্তি যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গিয়ে মারা যান, ঘটনার দিন সেই জায়গায় ভীষণ কাদা ছিল বলে সাক্ষীরা জানান। কিন্তু কাদার চিহ্ন ছিল না নিহতের শরীরে বা পোশাকে।

দিলীপ মণ্ডলকে না-ধরে পুলিশ দিলীপ তরফদারকে গ্রেফতার করেছিল কেন? নিছক নামের ফেরে বিভ্রান্ত হয়ে পুলিশ এটা করেছিল কি না, তা নিয়ে সংশয় এবং প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে।

তরফদার দিলীপের কৌঁসুলি সুবীরবাবু আদালতে জানান, কয়েক জন সাক্ষী পুলিশকে ও নিম্ন আদালতে জানান, খুনের ঘটনায় যে-দিলীপ অভিযুক্ত, তাঁর পদবি নস্কর। কিন্তু পুলিশ সেই দিলীপকে গ্রেফতারের চেষ্টাই করেনি। এমনকী দিলীপ মণ্ডল নামে ওই এলাকায় যে একাধিক ব্যক্তি রয়েছেন, পুলিশকে তা-ও জানানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও পুলিশ অন্য দিলীপ মণ্ডলদের জিজ্ঞাসাবাদটুকুও করেনি। তা ছাড়া মামলার অন্যতম সাক্ষী বুলু ঘোষ আদালতে জানান, সুখদেবের সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তাঁর (বুলুর) দাদা বলরাম ঘোষ। কিন্তু পুলিশ বলরামকে মামলার সাক্ষী বা অভিযুক্ত, কোনওটাই করেনি।

পুরোটাই নাম-বিভ্রাট, নাকি পুলিশের গাফিলতি বা অভিসন্ধি সেই প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে। তারই মধ্যে বিনা দোষে ১২ বছর জেল খাটার ক্ষতিপূরণ চেয়ে তাঁর মক্কেল ফের আদালতে যাচ্ছেন বলে জানান তরফদার দিলীপের আইনজীবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন