নবদ্বীপের গেরুয়া রঙে চিন্তায় তৃণমূল

ঘাসফুলের গাঢ় সবুজ জমিতে ফুটছে পদ্ম। রাজ্য জোড়া এই ছবির ব্যতিক্রম নয় মঠ-মন্দিরের শহর নবদ্বীপ। পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা ভোট মাত্র এক বছরের মধ্যে নদিয়ায় তৃণমূলের গড় বলে পরিচিত নবদ্বীপে বিজেপির ভোট এক লাফে প্রায় ১৪-১৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে তৃণমূলের পরেই দ্বিতীয় স্থানে তারা। বছর ঘুরলেই পুরভোট।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৪ ০০:১৭
Share:

ঘাসফুলের গাঢ় সবুজ জমিতে ফুটছে পদ্ম। রাজ্য জোড়া এই ছবির ব্যতিক্রম নয় মঠ-মন্দিরের শহর নবদ্বীপ। পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা ভোট মাত্র এক বছরের মধ্যে নদিয়ায় তৃণমূলের গড় বলে পরিচিত নবদ্বীপে বিজেপির ভোট এক লাফে প্রায় ১৪-১৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে তৃণমূলের পরেই দ্বিতীয় স্থানে তারা। বছর ঘুরলেই পুরভোট। টানা তিনবার নবদ্বীপ পুরসভায় ক্ষমতাসীন তৃণমূল কি কিছুটা চাপে? প্রকাশ্যে না বললেও এই নিয়ে দলের অন্দরে শুরু হয়েছে হিসাব-নিকাশ।

Advertisement

১৯৯৮ সালে তৃণমূল গঠিত হওয়ার পর থেকেই নদিয়া জেলার নবদ্বীপে ‘দুর্ভেদ্য দুর্গ’ গড়ে তোলে। ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে এই নবদ্বীপ লোকসভা কেন্দ্র থেকেই সদ্যোজাত তৃণমূলের টিকিটে জয়লাভ করেন দলের প্রথম সাংসদ আনন্দমোহন বিশ্বাস। পরের বছরই শহর নবদ্বীপ তৃণমূলকে উপহার দেয় পুরসভা পরিচালনার দায়িত্ব। জেলা জুড়ে যখন সিপিএমের প্রবল দাপট, তখন নবদ্বীপই ছিল নদিয়ার প্রথম পুরসভাযেখানে দু’দশক ধরে ক্ষমতাসীন সিপিএমকে অবিশ্বাস্য ভাবে হারিয়ে ২০০০ সালে পুরবোর্ড দখল করেছিল তৃণমূল। তবে, সেই নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গী ছিল বিজেপি। নবদ্বীপ পুরসভার ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে সেবার উনিশটি ওয়ার্ড দখল করেছিল তৃণমূল-বিজেপি জোট। বিজেপি একটি এবং তৃণমূল ১৮টি আসনে জয়ী হয়েছিল। নবদ্বীপে তৃণমূলের জয়যাত্রার সেই শুরু। এরপর একে-একে বিধানসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত,পঞ্চায়েত সমিতিসবই তৃণমূলের দখলে চলে আসে। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর নদিয়া জেলা পরিষদও তৃণমূলের দখলে এসেছে। রাজ্যের জনস্বাস্থ্য এবং কারিগরি দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা ২০০১ সাল থেকে টানা তিন বার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন নবদ্বীপ থেকেই।

১৯৯৯ থেকে ২০১৪এই দেড় দশকে নবদ্বীপের গ্রাম-শহরে জোড়াফুলের বাড়বাড়ন্তে গুরুত্ব হারিয়েছে সিপিএম। অস্তিত্বের সঙ্কটে কংগ্রেস। ২০১০ সালের পুরভোট থেকে নবদ্বীপে তৃণমূল একক ভাবেই চলেছে। বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের গাঁটছড়া ছিঁড়েছে বহু দিন। তৃণমূলের একদা জোট সঙ্গী বিজেপি ২০১০ সালের পুরসভা ভোটে নবদ্বীপের সব ক’টি ওয়ার্ডে প্রার্থী পর্যন্ত দিতে পারেনি। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে অবস্থা আরও সঙ্গিন। নবদ্বীপের গ্রাম-শহর মিলিয়ে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৭০৩৪ ভোট। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে মাত্র দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে এবং দু’টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল বিজেপি। মায়াপুর বামুনপুকুর পঞ্চায়েতের একটি মাত্র আসনে জিতেছিল তারা। দু’টি ক্ষেত্রেই বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল কমবেশি আড়াই শতাংশ।

Advertisement

এই ছবিটা হঠাৎ বদলে গিয়েছে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা ভোটে। নবদ্বীপ বিধানসভা থেকে পুরসভাসর্বত্র বিজেপি-র ভোট বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে। নবদ্বীপ কেন্দ্রে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৭০৩৪টি ভোট। এই লোকসভায় তা বেড়ে হয়েছে ৩১২২০ ভোট। শতাংশের হিসেবে যা প্রায় ১৭ শতাংশের বেশি। নদিয়া জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি তথা নবদ্বীপের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা জীবন সেন বলেন, “খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির বদল ঘটছে। এখানে আগের নির্বাচনগুলিতে আমরা আড়াই থেকে তিন শতাংশ ভোট পেয়েছি। কিন্তু লোকসভায় তা বেড়ে প্রায় ১৮ শতাংশ হয়েছে। অথচ আমাদের এখানে তেমন সংগঠন নেই। প্রচার করার সামর্থ্যও সীমিত। এমনকী আমরা প্রায় কোনও বুথেই এজেন্ট দিতে পারিনি। আসলে মানুষ মন থেকে বিজেপিকে চাইছেন এবং তৃণমূলকে প্রত্যাখ্যান করা শুরু করেছেন। এই ফল তারই ইঙ্গিত বহন করছে।” আসন্ন পুরভোটের কথা মাথায় রেখে নবদ্বীপের প্রতিটি ওয়ার্ডে বুথ কমিটি তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন জীবনবাবু।

নবদ্বীপ বিধানসভা কেন্দ্রে প্রাপ্ত মোট ৩১২২০ ভোটের মধ্যে নবদ্বীপ শহর থেকেই বিজেপি পেয়েছে ১৯৪৩৮টি ভোট। অন্য দিকে তৃণমূল পেয়েছে ৩৪৪১৫ ভোট। ১৭৫১৭ ভোট পেয়ে সিপিএম তৃতীয় স্থানে। ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৭টিতে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে। সাত নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের থেকে বিজেপি মাত্র ৩০ ভোটে পিছিয়ে আছে। পাঁচটি ওয়ার্ডে বিজেপি হাজারের উপর ভোট পেয়েছে। একটি ওয়ার্ডে পেয়েছে দেড় হাজারের বেশি ভোট। ফলাফলের এই হিসেব তৃণমূল নেতৃত্বের কপালের ভাঁজ গভীর করেছে। প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও দলের অন্দরে এই নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। কি ভাবে বিজেপি এত ভোট পেল তা নিয়ে চলছে কাটাছেঁড়া।

নবদ্বীপ শহর তৃণমূল সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ পাল বলেন, “এবারের লোকসভা ভোট ছিল কংগ্রেস বনাম বিজেপির সরাসরি লড়াই। তাতে মানুষ কংগ্রেসের জনবিরোধী নীতি এবং নানা কেলেঙ্কারিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিজেপিকে বেছে নিয়েছে। পাশাপাশি আমরাও রাজ্যে প্রায় তিন বছর শাসন ক্ষমতায় আছি। কিছু প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোট তৈরি হয়েছে। তবে এসব স্থানীয় পুরসভার ভোটে প্রভাব ফেলবে না।” নবদ্বীপ পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা আবার মনে করছেন, লোকসভায় সিপিএমের ভোট বিজেপি পেয়েছে। পুরসভায় সেটা হবে না। তিনি বলেন, “পুরসভায় ভোট হয় উন্নয়নের নিরিখে। সেখানে বিজেপির জায়গা নেই।” নবদ্বীপে তৃণমূলের প্রধান মুখ পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা বলেন, “সার্বিক ভাবে এ রাজ্যে বিজেপি তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। লোকসভায় তৃণমূলের আসন সংখ্যাই তার প্রমাণ। তবে সর্বত্র একটা হাওয়া দেখা গিয়েছে। নবদ্বীপও তার ব্যতিক্রম নয়।”

বাইরে নিশ্চিন্ত দেখালেও তৃণমূল ভোটের ফলাফলের কাটাছেঁড়া শুরু করে দিয়েছে। নবদ্বীপ শহরে কেবলমাত্র ৮ নম্বর ওয়ার্ডেই তৃণমূলের ‘লিড’ হাজার ছাড়িয়েছে। সেই ওয়ার্ডের পুরপিতা এবং পুরসভার জলবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মিহিরকান্তি পাল গম্ভীর ভাবে বলেন, “আমার ওয়ার্ডে দল ১০৪১ ভোটে লিড পেয়েছে এটা যেমন ঠিক তেমনই বিজেপিও ৭০০ ভোট পেয়েছে। নিয়মিত জনসংযোগ এবং কাজের পরও কেন এত মানুষ বিজেপিকে ভোট দিলেন এটা খুঁজে দেখতে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন