নবদ্বীপের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রম থেকে বাড়ির পথে।—নিজস্ব চিত্র।
ওঁদের বয়স চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে। পেশায় কেউ টোলের পণ্ডিতমশাই, কেউ সাইকেল মিস্ত্রি, কেউ পুরোহিত, কেউ আবার বাজারে মাছ বিক্রি করেন। চাষআবাদ করেন কেউ কেউ। সকলেরই সাকিন তেহট্ট ও লাগোয়া এলাকা। পেশা ওঁদের ভিন্ন হলেও নেশা একটাই ঘর থেকে দু’পা ফেলে চারপাশটা নিজেদের মতো করে ঘুরে দেখা। পায়ে হেঁটে নয়, ওঁরা বিশ্ব ঘুরে দেখেন সাইকেলে সওয়ার হয়ে। এমনই ছয় ‘যুবক’ আট দিনে আটশো কিলোমিটার সাইকেলে ঘুরে এলেন গঙ্গাসাগর। চলতে চলতে মাঝপথে ছুঁয়েছেন সুন্দরবন।
বুধবার বেলা ১১টা। নবদ্বীপ শহর ছাড়িয়ে একেবারে উত্তর প্রান্তে গঙ্গার তীরের জন্মস্থান আশ্রমে থামল কয়েকটি আটপৌরে সাইকেল। সামনে সাদা বোর্ডে লাল আর নীল রঙে লেখা‘দ্বিচক্র ভ্রমণ (সাইকেল)। তেহট্ট থেকে গঙ্গাসাগর ভায়া সুন্দরবন। শুভযাত্রা ২২ পৌষ, ১৪২১ বঙ্গাব্দ।’ সাইকেলের সামনে দু’দিকে দু’টি করে ঝোলা ব্যাগ। তাতে শীতের সামান্য পোশাক। পিছনে একটা করে ক্যারিয়ার। তার কোনওটিতে রান্নার গ্যাসের ছোট সিলিন্ডার, কোনওটিতে ওভেন। কারও সাইকেলে হাঁড়ি-কড়াই, কারও সাইকেলে আবার আস্ত একটা সাইকেলের দোকান। এই সামান্য আয়োজনে গত ৭ জানুয়ারি তেহট্ট বিডিও অফিস থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ওই দলটি। গঙ্গাসাগর ঘুরে সুন্দরবন ছুঁয়ে ঠিক আট দিনের মাথায় ১৪ জানুয়ারি, বুধবার সকালে নবদ্বীপে চৈতন্য জন্মস্থানে পৌঁছন পঞ্চাশ পার করা ওই ‘যুবকের’ দল। দলের বর্ষীয়ান সদস্য, তেহট্টের শ্যামনগরের বাসিন্দা ষাট ছুঁই ছুঁই যাদবেন্দু কাব্যতীর্থ একটি সংস্কৃত টোল চালান। তেহট্টের চিত্তরঞ্জন মুন্সি দলের কনিষ্ঠতম সদস্য। বয়স ৪২। পেশা যজমানি। দ্বিচক্র ভ্রমণের সফরের সাইকেল দেখভালের দায়িত্ব ৫৩ বছরের জয়ন্ত বিশ্বাসের। শ্যামনগরের বাসিন্দা জয়ন্তবাবু পেশায় সাইকেল মিস্ত্রি। রাধানগরের বাসিন্দা ৫৬ বছরের সুনীল মণ্ডল আর ৫৪ বছরের শিবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস পেশায় চাষি। সুনীল হালদার মাছ বিক্রি করেন। পাথেয় বলতে কারও পকেটে ৫০০ টাকা, কারও পকেটে ১৫০০ টাকা।
সফরের হিসেব কর্তা চিত্তরঞ্জন মুন্সি জানান, গঙ্গাসাগর ঘুরে আসতে খরচ হয়েছে কমবেশি চার হাজার টাকা। তিনি বলেন, “১৯৮৭ সালে আমরা দু’তিন জন প্রথম বার বেরিয়েছিলাম। তখন বয়স কম থাকলেও টাকা ছিল না। কম খরচে বেড়াতে সাইকেলের কোনও বিকল্প নেই। তাই গায়ের জোর সম্বল করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম।” সেই শুরু। তারপর থেকে প্রতি বছর শীতকালে সাইকেল নিয়ে ওঁরা পথে নামবেনই। ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছেন পুরী, দীঘা, জয়দেবের মেলা, শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা, ঝাড়খণ্ডের ম্যাসাঞ্জোর বাঁধ।
জয়ন্ত বিশ্বাস বলেন, “সাধ থাকলেও দেদার পয়সা খরচ করে বেড়ানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই বয়সের কথা না ভেবে পৌষমাস এলেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।” তিনি জানান দিনে ৭-৮ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে ১০০-১২০ কিমি পাড়ি জমান তাঁরা। কখনও মন্দির, কখনও পুলিশ ফাঁড়ি, কখনও বা পরিচিতের বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন ফের বেরিয়ে পড়েছেন। খাওয়াদাওয়া যে সময় মতো মিলেছে তাও নয়। টানা দু’দিন না খেয়েও দিন গিয়েছে। রান্নার আয়োজনও খুবই কম। কখনও খিচুড়ি, ওমলেট কখনও নানা রকম সব্জি দিয়ে সেদ্ধ ভাত। তাতে ঝামেলা যেমন কম, শরীরও ভাল থাকে।
বুধবার অবশ্য রান্নার তাড়া ছিল না। নবদ্বীপের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস তাঁদের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই নিশিন্তে বসে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন। বকখালির সাত মাইল বাজারে দুপুরের রান্নার জন্য চাল কিনতে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, সেখানে বেলা ১২টার পর কোনও দোকানদার কাউকে কিছু বিক্রি করেন না বিকেল না নামা পর্যন্ত। সেটাই প্রথা। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় এক মহিলার দাক্ষিণ্যে কোনও রকমে দুপুরের খাওয়া জোটে। আবার চেমাগুড়িতে জল চেয়েও জল পাননি। যাদুবেন্দুবাবু বলেন, “আগামী বার আমাদের ইচ্ছে আছে কাশী যাওয়ার। সংস্কৃত ভাষার পুনরুজ্জীবনের জন্য আমরা সাইকেলে চেপে কাশী যাব।” তবে সকলেরই ইচ্ছা--‘যদি একবার বাংলাদেশে যেতে পারতাম!’