কৃষ্ণগঞ্জ উপ নির্বাচন

প্রার্থী নিয়ে ক্ষোভ তৃণমূলে, সাবধানে ঘর গোছাচ্ছে বিজেপি

কৃষ্ণগঞ্জে অপর্ণা বাগ হত্যায় নাম জড়িয়েছিল তৃণমূলের। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দুয়ারে কড়া নাড়ছে উপ নির্বাচন। ঘটা করে সবার আগে প্রার্থীর নামও ঘোষণা করে দিয়েছে তৃণমূল। কিন্তু গোদের উপর বিষফোড়ার মতো প্রার্থী নিয়েও ক্ষুব্ধ দলের একটা বড় অংশ। ঠিক এমন আবহে অত্যন্ত সাবধানে নিজের ঘর গোছাতে শুরু করল বিজেপি।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share:

কৃষ্ণগঞ্জে অপর্ণা বাগ হত্যায় নাম জড়িয়েছিল তৃণমূলের। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দুয়ারে কড়া নাড়ছে উপ নির্বাচন। ঘটা করে সবার আগে প্রার্থীর নামও ঘোষণা করে দিয়েছে তৃণমূল। কিন্তু গোদের উপর বিষফোড়ার মতো প্রার্থী নিয়েও ক্ষুব্ধ দলের একটা বড় অংশ। ঠিক এমন আবহে অত্যন্ত সাবধানে নিজের ঘর গোছাতে শুরু করল বিজেপি।

Advertisement

রবিবার সকালে কৃষ্ণগঞ্জে বুথভিত্তিক কর্মী সম্মেলনের আয়োজন করেছিল বিজেপি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেলা ও রাজ্যের একাধিক নেতা। বিজেপির দাবি, এ দিনের সভায় প্রায় আট হাজার কর্মী উপস্থিত ছিলেন। দলের এক জেলা নেতা বলছেন, “তৃণমূল এখন ব্যস্ত নিজেদের প্রার্থী নিয়ে কোন্দল ঠেকাতে। সিপিএমের এখনও ঘুম ভাঙেনি। কংগ্রেসকে খুঁজে পাওয়াই দায়। নিজেদের সংগঠন আরও দৃঢ় করতে এই তো সেরা সময়।”

প্রবল ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে সম্মেলনে দলীয় কর্মীদের ভিড় দেখে রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক(সংগঠন) অমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের গলায় প্রত্যয়ের সুর। বলছেন, “এই ঠাণ্ডাতে এত কর্মীর ভিড়ই বলে দিচ্ছে ভোটের ফলাফল কী হতে চলেছে। আমরা জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত।”

Advertisement

কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের ১৫ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট ২৮৮ টি বুথের কর্মীরা এসেছিলেন। জেলা নেতৃত্বের দাবি, এত বড় কর্মী সম্মেলন গোটা জেলায় এই প্রথম। জেলা সভাপতি কল্যাণ নন্দী বলেন, “এই সম্মেলন না করলে আমরা জানতেই পারতাম না যে, মানুষের মনে বিজেপিকে নিয়ে কী বিরাট উন্মাদনা তৈরি হয়েছে।” তবে এই সম্মেলন নিয়ে দলের নেতারা উচ্ছ্বসিত হলেও তাঁরা তাঁদের বক্তব্যে যেমন সংযত থেকেছেন, ঠিক তেমনি কর্মীদেরকেও সবসময় সতর্ক ও সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

একাধিক বক্তা তাঁদের বক্তব্যে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে, কোনও পরিস্থিতিতেই তৃণমূলের ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না। তৃণমূলের লোকজন যদি পতাকা, ফ্লেক্স, পোষ্টার ছিঁড়ে দেয়, তাহলেও কর্মীরা যেন কোনও গোলমালে না জড়িয়ে পড়েন। প্রয়োজনে দলীয় কর্মীরা জেলা নেতৃত্বকে জানাবেন। তাঁরা যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবেন। নেতারা সতর্ক করে দিয়েছেন, “তৃণমূল নানা ভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করবে। আপনারা সেই ফাঁদে পা দেবেন না। ওরা সবসময় চেষ্টা করবে নানা অছিলায় গোলমাল করে পুলিশকে ব্যবহার করে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের গ্রেফতার করানোর।”

কল্যাণবাবু যেমন কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “আমাদের পতাকা, পোস্টার ছিঁড়ে দিক। আপনারা কেউ কিছু বলবেন না। সেগুলি ওই ভাবেই পড়ে থাকুক। আমরা আবার পতাকা, পোস্টার পাঠিয়ে দেব। ওরা আমাদের পতাকা, পোস্টার ছিঁড়তে ব্যস্ত থাকুক। আমরা সেই ফাঁকে আরও বেশি বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছে যাব।”

বিজেপি এখনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তা নিয়ে অবশ্য কর্মীদের কোনও মাথাব্যথাও নেই। সম্মেলনে যোগ দিতে আসা এক কর্মীর কথায়, “দলই শেষ কথা বলবে। দল যাঁকে যোগ্য মনে করবে তাঁকে প্রার্থী করবে। সবাই একসঙ্গে পরিশ্রম করে কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভায় বিজেপিকে জেতানোটাই আমাদের এখন একমাত্র কাজ। প্রার্থী নিয়ে বরং ওরা কোন্দল করুক।”

ওরা মানে যে তৃণমূল, তা বলাই বাহুল্য। গত ১৬ জানুয়ারি তৃণমূল কৃষ্ণগঞ্জের প্রার্থী হিসাবে সত্যজিৎ বিশ্বাসের নাম ঘোষণা করে। সত্যজিৎবাবু তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। প্রার্থীর নাম ঘোষণার পরেই ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি জেলা তৃণমূলের সিংহভাগ নেতা-কর্মীরা। কেন?

দলীয় সূত্রে খবর, এ বারের ওই নির্বাচনের জন্য মোট ছয় জনের নাম ছিল প্রার্থী তালিকায়। প্রার্থীদের দৌড়ে এগিয়েছিলেন জেলা তৃণমূলের সম্পাদক বিধান পোদ্দার। তিনি মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ। দলের একাংশের কথায়, “সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিধানবাবু দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হলেন। এর প্রভাব কিন্তু নির্বাচনের ফলে পড়বে।”

বিধানবাবুও কোনও রাখঢাক না করে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, “সব ছেড়েছুড়ে ওই এলাকায় সংগঠনটা আমিই তৈরি করেছি। অথচ উজ্জ্বলবাবুর ঘনিষ্ঠ বলেই আমাকে প্রার্থী করা হল না।” এমন অভিমানে তিনি যে বিজেপির সঙ্গে ইতিমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছেন সে কথাও তিনি গোপন রাখেননি। দলের এক জেলা নেতা বলছেন, “উপ নির্বাচনের আগেই তো আর একটা লড়াই শুরু হয়ে গেল। মন্ত্রী বনাম জেলা সভাপতির লড়াই।”

এর ফল যে ভাল হবে না তা নিয়ে একপ্রকার নিশ্চিত তৃণমূলের অনেকেই। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন ২০১১ সালের বিধানসভার কথা। সে বার তেহট্ট বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থীর দৌড়ে এগিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা যুব সভাপতি তাপস সাহা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাপসবাবুকে বঞ্চিত করে প্রার্থী করা হয় গৌরীশঙ্কর দত্তকে। ঠিক একই ভাবে অভিমান করে নির্দল প্রার্থী হিসাবে লড়াইয়ে নামেন তাপসবাবু। সেই ‘অপরাধে’ বেতাই কলেজ মাঠের প্রকাশ্য জনসভায় তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাপসবাবুকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।

কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা যায় যে, জয়ী হন সিপিএমের প্রার্থী। তাপসবাবু দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তৃণমূলের ওই জোয়ারেও গৌরীবাবুর স্থান হয় তিন নম্বরে! কৃষ্ণগঞ্জেও তেহট্টের পুনরাবৃত্তি হবে না তো? গৌরীবাবুর দাবি, “প্রার্থী নিয়ে আমাদের দলে কোনও সমস্যা নেই। আমরা তো কৃষ্ণগঞ্জে জিতবই। সেই সঙ্গে বিজেপির জামানত জব্দ করেই ছাড়ব। মিলিয়ে নেবেন।”

কংগ্রেসের জেলা সভাপতি অসীম সাহা বলেন, “কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের বগুলাতেই শনিবার সভা করে গিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। সেই সভায় লোকও অনেক হয়েছিল। কর্মীরাও চাঙ্গা হয়েছেন। বেশ কিছু যোগ্য ব্যক্তি প্রার্থী হতে চেয়ে আবেদনও করেছেন। তাঁদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিতে একটু সময় লাগছে। তবে জয়ের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।”

সিপিএমের জেলা নেতৃত্বের দাবি, তাঁরা মানুষের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখেন। কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছিতে জমি বাঁচাতে গিয়ে খুন হয়েছিলেন অপর্ণাদেবী। সেই তখন থেকেই তাঁরা ওই এলাকায় মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন। শুক্রবারও ওই এলাকায় কৃষক সভার পক্ষ থেকে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছে।

সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ঘুঘড়াগাছির ঘটনার পরে তৃণমূল তো ওই এলাকায় ঢুকতেই পারেনি। ওখানকার মানুষ তাদের কোনও ভাবেই চাইছেন না। ওই খুনের প্রতিবাদ মানুষ এই ভোটের মাধ্যমেই করবে। আমাদের কর্মীরা নীরবে প্রত্যেকটি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন