প্রার্থীরা আসেননি, তবু ভোটের সাজে অভিমানী চর মেঘনা

রোদের তেজে চারপাশ যেন পুড়ে যাচ্ছে। মাঠঘাটে তেমন কোনও ফসল নেই। তোড়জোড় শুরু হয়েছে পাট ও সব্জি চাষের। এখন শুধু বৃষ্টির অপেক্ষা। মেঠো রাস্তার পাশে পটোলের জমিতে মাচা বাঁধছিলেন চর মেঘনার মনোরঞ্জন মাহাতো। বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। কাঁধের মলিন গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন কলা বাগানের ছায়ায়। হাসতে হাসতেই বললেন, “ভোটের আগে প্রার্থীরা পর্যন্ত এ তল্লাটে এলেন না! আর ভোটের হাওয়া বুঝতে শেষে এই নেই রাজ্যে আসতে হল কর্তা?”

Advertisement

কল্লোল প্রামাণিক

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৮
Share:

রোদের তেজে চারপাশ যেন পুড়ে যাচ্ছে। মাঠঘাটে তেমন কোনও ফসল নেই। তোড়জোড় শুরু হয়েছে পাট ও সব্জি চাষের। এখন শুধু বৃষ্টির অপেক্ষা। মেঠো রাস্তার পাশে পটোলের জমিতে মাচা বাঁধছিলেন চর মেঘনার মনোরঞ্জন মাহাতো। বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। কাঁধের মলিন গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন কলা বাগানের ছায়ায়। হাসতে হাসতেই বললেন, “ভোটের আগে প্রার্থীরা পর্যন্ত এ তল্লাটে এলেন না! আর ভোটের হাওয়া বুঝতে শেষে এই নেই রাজ্যে আসতে হল কর্তা?”

Advertisement

মেঘনা বিএসএফ ক্যাম্প থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার এগিয়ে গেলে কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার গায়ে লোহার পেল্লাই সাইজের গেট। পাশেই বিএসএফের নজরদারি চৌকি। সেখানে ভোটার কার্ড জমা দিয়ে হাজারো প্রশ্ন বাণ সামলে তারপর মেলে চর মেঘনায় ঢোকার অনুমতি। গ্রামের শেষ সীমানা দিয়ে বয়ে গিয়েছে মাথাভাঙা। ওপারে মহিষকুণ্ডি, জামালপুর। জেলা কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।

কথায় কথায় গ্রামের দু’চারজন এগিয়ে এসে বসলেন স্কুলের সামনে শান বাঁধানো মাচায়। “এই যে স্কুলটা দেখছেন, এটাই আমাদের সবে ধন নীলমণি। আর বছর দুয়েক আগে গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। ব্যাস, আর কী চাই! সরকার, রাজনৈতিক দল সবাই বোধহয় এরকমই ভাবে। নইলে আমাদের সঙ্গেই কেন এমনটা হয়? নিজের দেশে থেকেও কেন বারবার দেখাতে হয় ভোটার কার্ড? কেন বিএসএফের কথায় আমাদের উঠতে-বসতে হবে? আমাদের কথা কি কেউ কোনওদিন ভাববে না?” অভিমান, রাগ, ক্ষোভ সব মিলেমিশে গলাটা যেন ঈষৎ ভারি হয়ে যায় বিশু সর্দারের।

Advertisement

ইতিউতি টাঙানো রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর পতাকা, ফেস্টুন। গ্রামের লোকজনই টাঙিয়েছেন। মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের করিমপুর বিধানসভা এলাকার মধ্যে পড়ছে চর মেঘনা। গ্রামে ভোটার রয়েছেন ৫৪৩ জন। এতদিন গ্রামের মানুষ ভোট দিতে যেতেন মেঘনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে গ্রামের স্কুলেই ভোট কেন্দ্র হচ্ছে। কিন্তু প্রার্থীরা এলেন না কেন? মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী মান্নান হোসেন গত বারের জয়ী সাংসদ। তিনি বলেন, “ওই এলাকায় যাওয়াটা খুব সমস্যার। বিএসএফ ঝামেলা করে। তাই যাওয়া হয়নি।” বিজেপি-র প্রার্থী সুজিতকুমার ঘোষ আবার না যেতে পারার জন্য দায়ী করেছেন প্রশাসনকে। তিনি বলছেন, “প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা না করায় ওই গ্রামে যেতে পারিনি।” তৃণমূলের প্রার্থী মহম্মদ আলি অবশ্য আক্ষেপের সুরে বলছেন, “চর মেঘনার সমস্যার কথা আমিও শুনেছি। তবে এই সীমিত সময়ের মধ্যে প্রচারে ওই গ্রামে যাওয়া হয়নি। তবে ভোটে হার-জিত যাই হোক ওই গ্রামে আমি অবশ্যই যাব।” সিপিএম প্রার্থী বদরুদ্দোজা খানের গলায় আবার আফশোস, “অন্য চর এলাকায় গিয়েছি। কিন্তু ওই এলাকাটা যে কী করে বাদ পড়ে গেল!” আর চর মেঘনা বলছে, একটা দিনের জন্য আসতেই হবু সাংসদদের মনে হচ্ছে কত ঝামেলা। তার জন্য কত কারণ, কত অজুহাত! অথচ সারাটা বছর গ্রামের মানুষ তো এ ভাবেই থাকেন। তার বেলা?

তাহলে ভোট দিচ্ছেন তো? করিমপুর পান্নাদেবী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ইতি মাহাতো বলছেন, “ভোট দেব না কেন? ভোট দেওয়াটা আমাদের অধিকার, কর্তব্য। আমরা সেটা ঠিক মতো পালন করি। এ বারেও করব। আর যাঁরা আমাদের ভোটে জিতে দিল্লি যাবেন তাঁরা তাঁদের কর্তব্যটুকুর কথা মনে রাখলেই আমরা খুশি।” স্কুলের সামনের জমাট ভিড়টাও সমস্বরে বলে ওঠে, “ইতি তো ঠিক কথাই বলেছে।”

বেলা পড়ে আসছে। আর একটু পরে হয়তো রাগও কমে আসবে চর মেঘনার। কিন্তু অভিমান? দমকা হাওয়ায় পতপত করে উড়তে থাকে রংবেরঙের দলীয় পতাকাগুলো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন