থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওঝাকে। —নিজস্ব চিত্র।
শাশুড়ির অসুস্থতার খবর পেয়ে বাড়িতে ওঝা ডেকে এনেছিলেন জামাই। আর ওঝা এসে ঝাড়ফুঁক করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, “এ তো প্রেতাত্মা কেস!” বৃহস্পতিবার রাতে ওই মহিলার প্রতিবেশী এক বৃদ্ধের নাম করে ওঝা সকলের সামনেই সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন, “ওঁর প্রেতাত্মাই ভর করেছিল। খুব কষ্ট করে ব্যাটাকে তাড়াতে হল।”
সাগরদিঘির দক্ষিণপাড়া গ্রামে ওঝার এমন কীর্তি শুনে শুক্রবার সকালে রীতিমতো তেতে ওঠে দক্ষিণগ্রাম। ওই ওঝা তখনও গ্রামেই ছিলেন। তাঁকে ঘিরে শুরু হয় বিক্ষোভ। পায়ে পায়ে সেখানে এসে হাজির হন ওই বৃদ্ধও। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “এটা কী ধরনের মস্করা বলুন তো? আমি তো দিব্যি বেঁচেবর্তে রয়েছি। আমার প্রেতাত্মা তাহলে কী করে ওই মহিলার উপর ভর করল?” ততক্ষণে ওঝাও বুঝে গিয়েছেন, এ ভূত সহজে ছাড়ার নয়। তিনি বলতে থাকেন, “বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। আমিও বুঝতে পারিনি যে, ওই বৃদ্ধ বেঁচে আছেন।” কিন্তু কে শোনে কার কথা?
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে খবর পেয়ে গ্রামে পুলিশ আসে। তারপর শুরু হয় আর এক নাটক। খোদ পুলিশ এসে ওঝার সপক্ষে সওয়াল করায় গ্রামবাসীরা পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত সাগরদিঘির ওসির নির্দেশে ওই ওঝাকে আটক করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। গ্রামবাসীরা বলছেন, “ভূতের মুখে রামনামের কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু পুলিশের মুখে ওঝার গুণগান এই প্রথম শুনলাম।” সাগরদিঘির ওসি পিন্টু মুখোপাধ্যায় বলেন, “গ্রামবাসীদের একাংশের পাশাপাশি কিছু পুলিশকর্মীর মধ্যেও কুসংস্কার রয়েছে। তাঁদের সকলকেই সচেতন করা দরকার। তবে ওই অফিসারের ওঝার ভূত ছাড়াতে যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এ দিন রাতেই অবশ্য গ্রেফতার করা হয় উজ্জ্বল প্রধান নামে ওই ওঝাকে।
ঘটনার শুরু মঙ্গলবার রাতে। গ্রামেরই এক মহিলা অস্বাভাবিক আচরন শুরু করেন। চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে গিয়ে তাঁর পরিবারের লোকজন মন্ত্র, তুকতাকের উপর ভরসা করতে শুরু করেন। কোনও কিছুতেই কাজ না হওয়ায় বৃহস্পতিবার দুপুরে পাশের ছামুগ্রাম থেকে উজ্জ্বল প্রধান নামে ওই ওঝাকে নিয়ে দক্ষিণগ্রামের বাড়িতে হাজির হন ওই মহিলার জামাই। তিনি বলেন, “বাপরে বাপ, ওঝার কেরামতি দেখে তো আমরাও থ। সন্ধ্যা পর্যন্ত ওঝার করে দেওয়া ফর্দ মিলিয়ে জিনিসপত্র আনা হয়েছিল। রাত ৮টা থেকে শুরু হয় ‘চিকিৎসা’। বাড়িতে ততক্ষণে লোকজনের ভিড় জমে গিয়েছে। তারপর রাতভর নানা কেরামতির পরে ওই ওঝা প্রতিবেশী এক বৃদ্ধের নাম করে বলেন যে তাঁরই প্রেতাত্মা নাকি শাশুড়ির উপরে ভর করেছিল।”
গ্রামের এমন খবর তো আর চাপা থাকে না। সকাল হতেই মুখে মুখে এই ঘটনার কথা গোটা গ্রামে রটে যায়। ওঝাকে ঘিরে শুরু হয় বিক্ষোভ। এই খবর পেয়ে দু’জন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন সাগরদিঘি থানার এক এএসআই। সব শুনে তিনি বলে বসেন, “ভূত ছাড়াতে তো ওঝাকেই ডাকতে হবে। এতে অন্যায়ের কী আছে!” এখানেই শেষ নয়, ওই পুলিশকর্মীর সংযোজন, “একবার তো আমার স্ত্রীকেও ভূতে ধরেছিল। পাশের গ্রাম থেকে ওঝা এনে সেই ভূত তাড়াতে হয়েছিল।” খোদ পুলিশের মুখে এমন ভূত, ওঝার কথা শুনে আর ধৈর্য রাখতে পারেননি গ্রামের যুবকেরা। পুলিশের সঙ্গে রীতিমতো বচসা শুরু হয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা বিপ্লব দত্ত বলেন, “আমরা ভাবতেই পারছি না পুলিশ কী করে এমন কথা বলতে পারে। ওই পুলিশ আধিকারিকের বিরুদ্ধে যাতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেই দাবি জানিয়ে ওসিকে লিখিত অভিযোগও দিয়েছি।” স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনন্ত দত্ত বলেন, “এই গ্রামে শিক্ষার হার নেহাত কম নয়। গ্রামের তিন কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১২ টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল। তারপরেও এই এলাকায় ওঝার দাপট রয়েছে। এটা সত্যিই লজ্জার। আমরাও গ্রামের লোকজনকে সচেতন করছি।”
জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “ওই পুলিশ অফিসার কেন এমন কথা বলেছেন তা আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।” তবে যে পুলিশের মন্তব্যে এমন বিতর্ক সেই এএসআই ইলাবান্তা ঘোষ অবশ্য এখনও নিজের যুক্তিতেই অনড়। বলছেন, “আমি তো অন্যায় কিছু বলিনি। ভূত ছাড়াতে ওঝাকে ডাকবে না তো কি ডাক্তারকে ডাকবে?”