পরিচয় হারিয়ে পুরসভার নোটিসেও অঞ্জনা এখন খাল

স্রোত হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন আস্ত নদীটাই বেমালুম হারিয়ে যেতে বসেছে! আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে জলঙ্গি থেকে শাখানদী হিসেবে উত্‌পত্তি হয় অঞ্জনার। ১৭৭৬ সালে রেনেল সাহেবের ‘সিস্টেমেটিক সার্ভে’-তে কিংবা বাংলা সাহিত্যেও এই নদীর বর্ণনা পাওয়া যায়।

Advertisement

মনিরুল শেখ

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৪ ০০:২৯
Share:

নিকাশি নালা নয়, কৃষ্ণনগরে অঞ্জনা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

স্রোত হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন আস্ত নদীটাই বেমালুম হারিয়ে যেতে বসেছে!

Advertisement

আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে জলঙ্গি থেকে শাখানদী হিসেবে উত্‌পত্তি হয় অঞ্জনার। ১৭৭৬ সালে রেনেল সাহেবের ‘সিস্টেমেটিক সার্ভে’-তে কিংবা বাংলা সাহিত্যেও এই নদীর বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে অঞ্জনার বেশিরভাগ অংশই দখলদারদের কব্জায় চলে গিয়েছে। কৃষ্ণনগর শহরের যাবতীয় বর্জ্য ফেলার এখন একমাত্র আধার এই নদী। মানুষের অত্যাচারে নদী আজ তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়েছে। কোথাও কোথাও নদী বিচ্ছিন্ন পুকুর বা দিঘির চেহারা নিয়েছে।

জলঙ্গির শাখানদী অঞ্জনা। কৃষ্ণনগরের কাছে ৫২ নম্বর রুইপুকুর মৌজা থেকে উত্‌পত্তি হয়ে অঞ্জনা কৃষ্ণনগরের প্রশাসনিক ভবনের পাশ দিয়ে ক্যাথিড্রাল চার্চের সামনে দিয়ে বেজিখালি মোড় হয়ে শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল অতিক্রম করে দোগাছির কাছে পৌঁছেছে। সেখানে হাটবোয়ালিয়ার কাছে নদীটি দু’ভাগে ভাগ হয়েছে। একটি অংশ জালালখালি, জলকর পাটুলি, বাদকুল্লা, চন্দনপুকুর হয়ে ৩৪ নম্বর ব্যাসপুর মৌজার কাছে চূর্ণী নদীতে মিশেছে। হেলেরখাল নামে পরিচিত অন্য অংশটি হাটবোয়ালিয়া থেকে যাত্রাপুর, জয়পুর, গোবিন্দপুর, ইটাবেড়িয়া, হয়ে হাঁসখালির কাছে চূর্ণী নদীতে মিশেছে।

Advertisement

অঞ্জনা নদী তার স্বাভাবিক ছন্দ হারাতে শুরু করেছে সেই রাজা-রাজাদের আমল থেকেই। জনশ্রুতি অনুযায়ী, কৃষ্ণনগরের রাজা রুদ্র রায়ের সময়কালে (১৬৮৩-১৬৯৪) অঞ্জনার উপর প্রথম আঘাত নেমে আসে। নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধা পায়। সেই ধারা আজও অব্যাহত। বেজিখালির মোড় থেকে হরিজনপল্লি পর্যন্ত কয়েকশো মিটার বিস্তীর্ণ রাস্তার ডান দিক দিয়ে প্রবাহিত অঞ্জনা এতটাই সরু যে নদী বলে মালুম হওয়া দায়। রাস্তার মাঝে পুরসভার টাঙানো হোর্ডিংয়েও অঞ্জনাকে নদী বলে উল্লেখ নেই। সেখানে পরিষ্কার লেখা রয়েছে, “অঞ্জনা খাল ভরাট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ এই খালে মাটি বা অন্যান্য সামগ্রী ফেলিয়া ভরাট করার চেষ্টা করলে পুরসভা তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।”

পুরসভার নোটিসে যাকে বলছে খাল। নীচে মানচিত্রে গতিপথ।

কিন্তু সে সতর্কবার্তাই সার। নদীতে দেদার ফেলা হচ্ছে নোংরা,আবর্জনা। নদীর বুকে মাটি ফেলে গজিয়ে উঠেছে বহুতল বাড়ি। বেজিখালি মোড়েই নদী বুজিয়ে তৈরি করা হয়েছে আবর্জনা ফেলার ‘ভ্যাট’। সেখানে গৃহস্থালীর দৈনন্দিন নোংরা ফেলা হচ্ছে নিয়ম করে। আশপাশের দোকানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক, চায়ের ভাঁড়, অপ্রয়োজনীয় ফ্লেক্স-ব্যানার সবই পড়ছে নদীর বুকে গজিয়ে ওঠা ভ্যাটে। আবর্জনার স্তূপ পেরিয়ে মিটার তিরিশেক দূরে নদীবক্ষেই তৈরি হয়েছে দোকানপাট। সেখানে নদীর অস্তিত্ব বোঝা মুশকিল। অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বেড়ে ওঠা আগাছা, ঘন কচু বন নদীকে ঢেকে দিয়েছে। কচু বন পেরিয়ে নদীর গতিপথকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়ে তৈরি হয়েছে পিচ ঢালা রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে সঙ্কীর্ণ অঞ্জনা পুনরায় আঁকাবাঁকা পথে যাত্রা শুরু করে পৌঁছেছে শক্তিনগর হাসপাতালের কাছে। ২০০৪ সাল নাগাদ জেলা হাসপাতালে গোটা পাঁচেক নিকাশি-নালা তৈরি হয়। সেই নালা দিয়ে হাসপাতালের সমস্ত বর্জ্য প্রতিনিয়ত গিয়ে পড়ছে নদীতে। এমনকী শহরের বেশিরভাগ জায়গারই নোংরা জল না‌লার মাধ্যমে এসে মিশছে নদীতে।

কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা বলেন, “অঞ্জনা না থাকলে ২০০০ সালে কৃষ্ণনগর জলের তলায় চলে যেত। এ রকম একটা নদীর সংস্কার আমরা করবই। তবে অঞ্জনার মালিকানা আমাদের হাতে নেই। তা রয়েছে সেচ ও মত্‌স্য দফতরের হাতে।” কিন্তু আবর্জনা ফেলা বা জবরদখল রোধে পুরসভা কী করছে? অসীমবাবু বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছি।” যদিও সে পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত বাস্তবে স্পষ্ট ভাবে দেখা গেল না। এ দিকে, খামারসিমুলিয়া, ব্যাসপুর, পাটুলির কাছে অঞ্জনার উপর দিব্যি চলছে চাষ-আবাদ। পঞ্চায়েত বা প্রশাসনের অবশ্য সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।

শহরের মধ্যেই অঞ্জনার উপর ‘উন্নয়নের’ স্বার্থে তৈরি হয়েছে এক ডজন কালভার্ট। ২০০০ সালের বন্যার সময় অবশ্য কৃষ্ণনগর পুরসভা নদী থেকে জবরদখলকারীদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা হাতে নেয়। নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার তাঁর ‘নদিয়ার নদ-নদী ও জলভূমি কথা’ গ্রন্থে লিখছেন, ‘বন্যার সময় শহরের জল নামানোর ক্ষেত্রে অঞ্জনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তারপর পুরসভা এই নদীর বহতাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। ততদিনে অবশ্য পুরসভার নথিই বলছে, শহরের মধ্যে নদীর ৮৯ শতাংশ অংশই চলে গেছে লুঠেরাদের হাতে।’

স্বাধীনতার পর থেকে মাঝেমধ্যেই অপরিকল্পিতভাবে কিছু জায়গায় অঞ্জনার সংস্কার শুরু হয়েছিল। ১৯৫১ সালে নদিয়া জেলার তত্‌কালীন ম্যাজিস্ট্রেট মনীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অঞ্জনার সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে সেই চেষ্টা সেভাবে ফলদায়ক হয়নি। তবে ২০০৬ সালে জেলা পরিষদের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরের দক্ষিণে অঞ্জনার সামান্য সংস্কার হয়েছিল। ২০০৮ সালে কৃষ্ণনগর উত্তরের তত্‌কালীন বিধায়ক সিপিআই (এম) এর সুবিনয় ঘোষের বিধায়ক এলাকা উন্নয়ন তহবিলের অর্থে সংস্কার শুরু হলেও সেভাবে অগ্রসর হয়নি জেলা প্রশাসন।

একশো দিনের কাজে স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর অঞ্জনা সহ মৃতপ্রায় নদ-নদী ও খাল-বিলের বহতা ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা হাতে নেয় জেলা প্রশাসন। স্থির হয়, এই খাতে ৪০ লক্ষ কর্মদিবস কাজে লাগানো হবে এই খাতে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই কাজে সেভাবে অগ্রগতি আসেনি। কৃষ্ণনগর শহরে একদমই কাজ শুরু হয়নি। কারণ, আইনে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, শহর এলাকায় একশো দিনের কাজ করানো যাবে না। এ ব্যাপারে নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিম বলছেন, “শহরের বাইরে অঞ্জনার দৈর্ঘ্য ১৬ কিলোমিটার। সেখানে প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের সংস্কার হয়েছে এবং ওই সব এলাকার দখল‌দারদেরও উত্‌খাত করা হয়েছে।” কিন্তু শহরে কী হবে? জেলাশাসকের জবাব, “এখানে সেচ দফতর বা পুরসভার সাহায্যে সংস্কারের চেষ্টা করা হবে অথবা কোনও বিশেষ স্কিমের মাধ্যমেও নদী সংস্কার করা যেতে পারে।”

কিন্তু কবে? উত্তর জানে না কৃষ্ণনগর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন