পড়ুয়াদের সামনে হাঁসুয়ার কোপ শিক্ষককে

মিড ডে মিলের মান নিয়ে প্রতিবাদ করায় পড়ুয়াদের সামনে হাঁসুয়া দিয়ে কোপানো হল স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে। গুরুতর জখম অবস্থায় সামসুজ্জামান শেখ নামে ওই শিক্ষককে প্রথমে সাগরদিঘি গ্রামীণ হাসপাতাল ও পরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বুধবার দুপুরে সাগরদিঘির দোগাছি জুনিয়র হাইস্কুলের এমন ঘটনার পরে রীতিমতো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। আতঙ্কে রয়েছে স্কুলের পড়ুয়ারাও। জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “ওই ঘটনায় খুনের চেষ্টার মামলা রুজু হয়েছে। মিড ডে মিলের রাঁধুনির স্বামী অভিযুক্ত দুখু ঘোষের খোঁজে তল্লাশিও চলছে।”

Advertisement

বিমান হাজরা

সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৫ ০১:০৮
Share:

জখম সেই শিক্ষক। —নিজস্ব চিত্র।

মিড ডে মিলের মান নিয়ে প্রতিবাদ করায় পড়ুয়াদের সামনে হাঁসুয়া দিয়ে কোপানো হল স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে। গুরুতর জখম অবস্থায় সামসুজ্জামান শেখ নামে ওই শিক্ষককে প্রথমে সাগরদিঘি গ্রামীণ হাসপাতাল ও পরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বুধবার দুপুরে সাগরদিঘির দোগাছি জুনিয়র হাইস্কুলের এমন ঘটনার পরে রীতিমতো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। আতঙ্কে রয়েছে স্কুলের পড়ুয়ারাও। জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “ওই ঘটনায় খুনের চেষ্টার মামলা রুজু হয়েছে। মিড ডে মিলের রাঁধুনির স্বামী অভিযুক্ত দুখু ঘোষের খোঁজে তল্লাশিও চলছে।”

Advertisement

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ ষষ্ঠ শ্রেণির পরিবেশ ও বিজ্ঞানের ক্লাস নিচ্ছিলেন সামসুজ্জামান। পড়ুয়ারাও মন দিয়ে শিক্ষকের কথা শুনছিলেন। আচমকা ওই শিক্ষককে গালিগালাজ করতে করতে শ্রেণিকক্ষে ঢোকে স্কুলের মিড ডে মিলের এক রাঁধুনির স্বামী দুখু। হাতে ধারাল হাঁসুয়া। দুখুর ওই তর্জন গর্জনে চমকে ওঠেন শিক্ষক-সহ পড়ুয়ারা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামসুজ্জামানের গলা লক্ষ্য করে হাঁসুয়া চালায় দুখু। ভয় পেয়ে ওই শিক্ষক মাথা নিচু করতেই হাঁসুয়ার কোপ গিয়ে পড়ে তাঁর মাথায়। রক্তাক্ত অবস্থায় সামসুজ্জামান মাটিতে পড়ে যান। শ্রেণিকক্ষের মধ্যে শ’দুয়েক পড়ুয়া তখন আতঙ্কে কাঁপছে। বহু পড়ুয়া ভয়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে দৌড়ে বাড়িতে চলে যায়। ঘটনার পরে চম্পট দেয় দুখুও।

সামসুজ্জামানের ওই অবস্থা দেখে ছুটে আসেন স্কুলের এক করণিক ও লাগোয়া প্রাথমিক স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরাও। তাঁরাই তড়িঘড়ি ওই শিক্ষককে সাগরদিঘি গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যান। আশঙ্কাজনক অবস্থায় সেখান থেকে এ দিন বিকেলেই তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ঘটনার পরে গ্রামে পুলিশ এলেও দুখুর কোনও সন্ধান পায়নি তারা। তৃণমূল-সহ জেলার অন্যান্য শিক্ষক সংগঠনগুলি এই ঘটনায় রীতিমত উদ্বেগ প্রকাশ করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার দাবি জানিয়েছে প্রশাসনের কাছে। সাগরদিঘি থানার পুলিশ জানিয়েছে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে একটি খুনের চেষ্টার মামলা রুজু করা হয়েছে। তবে বুধবার রাত পর্যন্ত অভিযুক্ত দুখু ঘোষকে ধরতে পারেনি পুলিশ।

Advertisement

কিন্তু কী এমন ঘটেছিল যার জন্য দুখু ঘোষ এমন কাণ্ড ঘটাল? স্কুল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বেশ কয়েকদিন ধরেই স্কুলের মিড ডে মিল নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ উঠছিল রাঁধুনিদের বিরুদ্ধে। সামসুজ্জামান তারপরেই মিড ডে মিলে নজরদারি শুরু করেন। স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়েই তৈরি করেন মন্ত্রীসভা। পড়ুয়ারাও রান্নার কাজে নজর রাখছিল। আর তাতে ফলও মিলছিল। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের এমন পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রাঁধুনিরা। অভিযুক্ত দুখুর স্ত্রী দোগাছি জুনিয়র হাই স্কুলের রাঁধুনি। তাঁর বাড়িও স্কুলের পাশেই। অভিযোগ, এ দিন টিফিনের পরে ক্লাস শুরু হতেই সামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ওই মহিলা তাঁর স্বামী দুখুকে ডেকে আনেন। এরপরেই দুখু স্কুলে ঢুকে ওি শিক্ষককে কোপায়।

কান্দির যশহরি গ্রামের বাসিন্দা সামসুজ্জামান ওই ঘটনায় এতটাই আতঙ্কিত যে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে কোনওমতে তিনি বলেন, “পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ২১৫ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে স্কুলে। একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর তিন জন মহিলা রান্নার কাজ করেন স্কুলে। গত কয়েকদিন থেকে ছাত্রদের কাছ থেকে অভিযোগ পাচ্ছিলাম রান্নার মান খারাপ হচ্ছে। ঠিকমতো চাল দেওয়া সত্বেও সব ছাত্র খাবার পাচ্ছে না। রাঁধুনিদের এ নিয়ে সতর্ক করা হয়। চাল চুরি রুখতে ছাত্রদের নিয়ে একটি মন্ত্রীসভাও গড়া হয়। তারপর থেকে চাল চুরি-সহ অন্যান্য অনিয়মও বন্ধ হয়ে যায়। আর তাতেই গোঁসা হয় রাঁধুনিদের। সেই রাগ থেকে যে এমন ঘটনা ঘটবে তা ভাবতেও পারিনি।”

ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মইনুর শেখ বলে, “আমাদের সামনেই স্যারের মাথায় ওই লোকটি হাঁসুয়া দিয়ে কোপাল। আমরা তো ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলাম।” অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মইদুল সেখ বলে, “ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসি আমরাও। ওই লোকটির হাতে রক্তমাখা হাঁসুয়া দেখে ওর দিকে কেউ যেতে সাহস পাচ্ছিল না। আমি দৌড়ে গিয়ে পাড়ার কয়েকজনকে ডেকে আনি।” লাগোয়া প্রাথমিক স্কুলের পার্শ্বশিক্ষক সঞ্জীব ঘোষ বলেন, “চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে দেখি ওই শিক্ষক মাটিতে পড়ে রয়েছেন। রক্তে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। এরপরে কোনওমতে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।” ওই জুনিয়র হাইস্কুলে রয়েছেন মাত্র দু’জন শিক্ষক। এ দিন আবার একজন আসেননি। স্কুলের করণিক অনির্বাণ দাস বলেন, ‘‘গ্রামের অনেকেই প্রয়োজনে স্কুলে আসেন। কিন্তু এ ভাবে হাঁসুয়া নিয়ে স্কুলে ঢুকে ওই লোকটি যে এমন করবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। এমন ঘটনার পরে তো আমরাও ভয় পাচ্ছি।”

সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক পঙ্কজ পাল বলেন, ‘‘কল্পনাই করতে পারছি না যে, এ ভাবে কোনও শিক্ষককে ক্লাসে ঢুকে কেউ মারতে পারে।” জেলার তৃণমূলের শিক্ষা সেলের চেয়ারম্যান শেখ ফুরকান বলেন, “অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা।” এবিটিএর জেলা সম্পাদক দুলাল দত্ত বলেন, “সব ক্ষেত্রেই রাজ্যের পরিবেশ কী ভাবে বিষিয়ে উঠেছে এই ঘটনা তা আরও একবার প্রমাণ করে দিল।” কংগ্রেসের মাধ্যমিক শিক্ষক সংগঠনের জেলার সহকারি সভাপতি ও জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ আশিস তেওয়ারি বলেন, ‘‘স্কুলে ঢুকে শিক্ষক হেনস্থা নতুন নয়। তবে এই ঘটনা নজিরবিহীন। প্রশাসনের উচিত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন