বিদ্যুৎ এসেছে, চরের গ্রাম তবু হতাশার আঁধারে

গঙ্গার ধার বরাবর তিনটে গ্রাম। গঙ্গায় জল বাড়লে গ্রামের মাটির ঘরের উঠোনেও জল থই-থই। নদিয়ার ভূখণ্ডে গঙ্গার চর। কিন্তু বাসিন্দাদের রেশন কার্ড থেকে স্থানীয় প্রাথমিক স্কুল যা না কি বর্ষায় ত্রাণশিবির হয়, তার দেওয়ালে ‘চন্দ্রহাটি, জেলা হুগলি’ লেখা। দীর্ঘ ৩৪ বছর টালবাহানার পরে তিন গ্রামের বাসিন্দার সরকারি সচিত্র পরিচয়পত্রের স্থায়ী ঠিকানায় জেলার নাম এখন নদিয়া।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য

চরযাত্রাসিদ্ধি শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৫৮
Share:

বার বার দাবি উঠলেও হয়নি কংক্রিটের সেতু।—নিজস্ব চিত্র।

গঙ্গার ধার বরাবর তিনটে গ্রাম।

Advertisement

গঙ্গায় জল বাড়লে গ্রামের মাটির ঘরের উঠোনেও জল থই-থই। নদিয়ার ভূখণ্ডে গঙ্গার চর। কিন্তু বাসিন্দাদের রেশন কার্ড থেকে স্থানীয় প্রাথমিক স্কুল যা না কি বর্ষায় ত্রাণশিবির হয়, তার দেওয়ালে ‘চন্দ্রহাটি, জেলা হুগলি’ লেখা।

দীর্ঘ ৩৪ বছর টালবাহানার পরে তিন গ্রামের বাসিন্দার সরকারি সচিত্র পরিচয়পত্রের স্থায়ী ঠিকানায় জেলার নাম এখন নদিয়া। কিন্তু রেশন কার্ড বদলায়নি। ফলে ব্যাঙ্ক হোক বা স্কুল, দু’টি সরকারি পরিচয়পত্রে দু’রকম ঠিকানায় সমস্যা আগের মতোই রয়ে গিয়েছে। ভোটের আবার মানচিত্রে কল্যাণীর অদূরে চরজাজিরা, চরযাত্রাসিদ্ধি আর চরযদুবাটি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অধীন। ফলে আরও ধোঁয়াটে সব কিছু।

Advertisement

২০০৯ সালের আগে পর্যন্ত এই এলাকায় এলে মনে হত, যেন দুই দেশের সীমান্তে কোনও এক ছিটমহল। যেখানে বসতি আছে কিন্তু রাস্তা নেই, হাইস্কুল নেই, পরিশ্রুত পানীয় জল নেই, চিকিৎসা নেই। আগের লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ভোট দেওয়ার অধিকার পান এখানকার বাসিন্দারা। প্রবীণ গ্রামবাসী সন্তোষ মাহাতো বলেন, “এত বছর বেওয়ারিশের মতো থাকার পরে যখন নাগরিকত্ব মিলল, তখনই আগের বারের তৃণমূল প্রার্থী গোবিন্দচন্দ্র নস্কর ভোট চাইতে এলেন। আর কোনও দল তো কখনও আসেনি। এই প্রথম এক জন প্রার্থী এসে হাতজোড় করে গ্রামের মন্দিরের সামনে শপথ করে বললেন, জিতলে তাঁর প্রথম কাজ হবে কল্যাণী শহরের সঙ্গে যোগাযোগের এক মাত্র মাধ্যম নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোগুলো কংক্রিটের করে দেওয়া।”

গোবিন্দ্রচন্দ্র জিতলেন। তার পর কী হল? “উনি বলেছিলেন, হাসপাতাল হবে, স্কুল হবে। আর রাস্তা বাঁধিয়ে দেবেন। উনি জিতলেন, ব্যস্ত লোক তো! তাই আমাদের গ্রামে পাঁচ বছরে আর আসা হয়নি ওঁর। প্রতিশ্রুতির কথাও ভুলে গিয়েছেন” বলে হাঁফ ছাড়েন সন্তোষবাবু। তৃণমূলের বতর্মান প্রার্থী কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর দিন কয়েক আগে ওই গ্রামে গিয়েছিলেন। তাঁকে কেমন দেখলেন? “আগের জন যদি বা বিনীত ভাবে দোরে-দোরে ঘুরে ভোট ভিক্ষা করেছিলেন, কথা বলেছিলেন লোকজনের সঙ্গে, এ বারের জন তো মোটরবাইকে চেপে রাস্তা দিয়ে চলে গেলেন। বাসিন্দাদের সঙ্গে দুঃখকষ্ট নিয়ে কথা বললেন কই?” গলা নামিয়ে বলছে চরের গ্রাম।

কপিলকৃষ্ণ অবশ্য অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, “প্রচারের সময়ে যত জনের সঙ্গে কথা বলা যায়, বলেছি। মুখের কথায় নয়, কাজ করে প্রমাণ করব।”

কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে ২০০৯ সালের পরে?

কল্যাণীর বিধায়ক রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের তহবিলের টাকায় চরযদুবাটি ও চরযাত্রাসিদ্ধির মধ্যে বাঁশের সাঁকোয় কংক্রিটের স্ল্যাব তৈরি হয়েই থেমে গিয়েছে। ওই দুই গ্রামের কিছু রাস্তায় ইট পড়লেও বেশির ভাগটাই মাটির রাস্তা। বর্ষায় কাদা। গঙ্গায় জল বাড়লে হাঁটুজল। প্রাথমিক স্কুল আছে নাম-কা-ওয়াস্তে। হাইস্কুল মানে সেই নদী পেরিয়ে চন্দ্রহাটি। কল্যাণীতে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থাকলেও জরুরি অবস্থায় সেখানে পৌঁছনো যায় না। কেননা গ্রামে অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকে না। বাঁশের সাঁকো দিয়ে খাটিয়ায় চাপিয়ে রোগীকে চরযদুবাটি অবধি নিয়ে যাওয়ার পরে ভ্যান মেলে। তাই রাতবিরেতে ভরসা হুগলির হাসপাতাল। বৃষ্টি-বাদলায় তা-ও মেলে না। তবে বিদ্যুৎ ঢুকেছে গ্রামে, এটুকুই যা আশার আলো।

চরযাত্রাসিদ্ধির পঞ্চায়েত সদস্য হেমন্তী মাহাতো বলেন, “গ্রামে ৫০টা খাটিয়া আছে। কেউ অসুস্থ হলে খাটিয়াই ভরসা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যায় কত জন। শুধু এই গ্রামেই প্রায় ১১০০ ভোটার আছে। তবু কি হুঁশ আছে কারও? আবার ভোট আসছে। আবার আশ্বাস। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন দেখানো হয়। সত্যি হওয়ার রাস্তাটা তো আমরাই জানি না। লোককে কি বলব?”

শুধু বিদ্যুতে কি আর আলো জ্বলে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন