অজয় ঘোষ
ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করার মূল্য চোকাতে হল প্রাণ দিয়ে। পরীক্ষা চলাকালীন স্কুলচত্বরে ঢুকে একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রকে গুলি করে পালাল কিছু যুবক।
বুধবার বিকেল ৫টা নাগাদ নদিয়ার শান্তিপুরে ফুলিয়া বিদ্যামন্দিরে ঘটনাটি ঘটে। নিহত অজয় ঘোষের (১৭) বাড়ি ফুলিয়ার বঁুইচা ব্যাঙগর্ত কলোনিতে। তারই কিছু সহপাঠী এই ঘটনায় জড়িত বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। ইতিমধ্যে ফুলিয়া বিদ্যামন্দির ও পাশের স্কুলের দুই ছাত্রকে আটক করেছে পুলিশ। তবে, ইভটিজিং নয়, ত্রিকোণ প্রেমের জেরে ঘটনাটি ঘটেছে বলে দাবি রানাঘাটের এসডিপিও আজহার এ তৌফিকের।
স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২৪ মার্চ ইতিহাস পরীক্ষার শেষে বাড়ি ফেরার সময় অজয়ের এক সহপাঠিনী তাকে ডাকতে এসেছিল। সেই সময় পাশের একটি স্কুল ও এলাকার কিছু ছেলে ওই ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করে। প্রতিবাদ করলে অজয়ের সঙ্গে তাদের বচসা বাধে। হাতাহাতিও হয়। যে ছাত্রীকে নিয়ে গণ্ডগোল, তার কথায়, “আমাদের সম্পর্ক নিছকই বন্ধুত্বের। কাছাকাছি বাড়ি বলে একসঙ্গে ফিরি আমরা। ওই দিন অজয়কে ডাকতে গেলে পাশের স্কুলের কিছু ছেলে পাশ থেকে টিটকিরি কাটে আমার উদ্দেশে। খারাপ অঙ্গভঙ্গী করে। প্রতিবাদ করায় অজয়কে মারধর করে ওরা। দেখে নেবে বলে হুমকি দেয়।”
বুধবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরীক্ষা ছিল। ২টো থেকে সোয়া ৫টা পর্যন্ত পরীক্ষা। কিছু সময় আগেই খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল অজয়। স্কুলচত্বরের একটি কলে মুখ ধুচ্ছিল যখন, তখনই ১০-১২ জনের একটি দল স্কুলে ঢোকে। এক সহপাঠীর কথায়, “ওই দলে আমাদের স্কুলের চার ছাত্র ছিল। বাকিদের চিনতে পারিনি। ওরা অজয়কে প্রথমে কিল-চড় মারতে থাকে। পরে এক জন হঠাত্ পকেট থেকে পিস্তল বার করে মাথায় গুলি করে। এরপর সবাই হেলতে-দুলতে চলে যায়।”
স্কুলের শিক্ষক সুমিত দাস বলেন, “হঠাত্ প্রচন্ড জোরে শব্দ পাই। তবে পরীক্ষা চলছিল বলে বেরোতে পারিনি। একটু পরে কয়েকজন ছাত্র ছুটতে ছুটতে এসে ভয়ঙ্কর সংবাদ দেয়। আমরা বাইরে বেরিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে অজয়। ওরই কিছু সহপাঠী হাসপাতালে নিয়ে যায়।” গুরুতর জখম অজয়কে রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিত্সকরা মৃত বলে জানান। আজ, সেখানেই তার ময়না-তদন্ত হবে।
এ দিকে, অজয়ের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর আসতেই প্রথমে স্কুল ও পরে রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে ছুটে আসেন আত্মীয়-প্রতিবেশীরা। পিলুর (অজয়ের ডাকনাম) নিথর দেহ আঁকড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা রমা ঘোষ। তিনি বলেন, “পরীক্ষার তাড়ায় দুপুরে সামান্য ভাত খেয়ে বেরিয়েছিল। বলেছিল, ফিরে এসে ভাল করে খাব। ও যে আর কোনও দিন ফিরবে না কে জানত। এই দেখব বলে কি ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়েছিলাম আমরা।”
অজয়ের বাবা পেশায় তাঁতশ্রমিক দীপকবাবু ছোট ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। সেই কারণে মাঝ রাস্তা থেকে তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, অজয়রা দুই ভাই। দাদা প্রসূন কলকাতায় একটি সোনার দোকানে কাজ করেন। সংসারের ঠেলায় বড় ছেলের বেশি দূর পড়াশোনা হয়নি বলে আক্ষেপ ছিল দীপকবাবুর।
ছোটটা অন্তত ভালভাবে লেখাপড়া শিখে প্রতিষ্ঠিত যাতে হয়, তার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন তিনি। লেখাপড়াতে ভাল ছিল অজয়। এলাকায় সকলে তাকে মিশুকে ও ভদ্র ছেলে বলেই জানত। অজয়ের কাকা প্রবীরবাবু বলছেন, “ওর যে কোনও শত্রু থাকতে পারে এটা আমরা ভাবতেই পারছি না।”
সহপাঠীরা এই খুনের ঘটনায় জড়িত শোনার পরে বিস্ময় আরও বেড়েছে তাঁদের। তবে ফুলিয়া বরবারই অশান্ত এলাকা বলে পরিচিত।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটা খুনের ঘটনা ঘটেছে পরপর। এ দিনই ফুলিয়া মাঠপাড়া এলাকা থেতে মিঠুন দাস নামে এক দুষ্কৃতীকে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ গ্রেফতার করা হয়েছে।
স্থানীয় শান্তিপুর পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূলের সহ-সভাপতি রঘুনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি বান্ধবীকে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করেছিল ওই ছাত্র। ওর নিজের স্কুল ও পাশের স্কুলের কিছু ছাত্র এই ঘটনায় জড়িত বলে শোনা যাচ্ছে। ছোটদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে-বাড়তে এই জায়গায় পৌঁছেছে, বিশ্বাস হয় না।”
এরই মধ্যে পুরো ঘটনায় স্কুলের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ মৃতের পরিজনেরা। হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী সুদেব শীল, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়রা বলেন, “এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। অথচ স্কুল থেকে কেউ এলেন না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।” অজয়ের সহপাঠীরাও বলছে, স্কুল থেকে কোনও সাহায্য করা হয়নি। এক সহপাঠী বলেন, “স্যাররা সবাই দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরাই হাসপাতালে নিয়ে আসি। না তখন কেউ আমাদের সঙ্গে এসেছে, না পরে।”
প্রধান শিক্ষক অসিত কুমার মণ্ডল বলেন, “আমি স্কুলে ছিলাম না। তবে, সেই সময় হয়তো শিক্ষকেরা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া পুলিশ তো এসেছিল। তবে, ছাত্রদের হাতে বন্দুকটা সত্যিই ভাবাচ্ছে আমাদের। সামাজিক অবক্ষয় কোথায় পৌঁছলে এমনটা হতে পারে।”