ঐতিহ্যবাহী নবদ্বীপের রাসকে শৃঙ্খলায় বাধতে বেশ কিছু কড়া নীতি নিল নদিয়া জেলা প্রশাসন।
নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হওয়া নবদ্বীপের রাস উত্সবের বয়স আড়াইশো বছরেরও বেশি। কালের নিয়মে নদিয়া রাজের যুগ শেষ হয়ে গেলেও নবদ্বীপের রাসের সেই মেজাজটা এখনও রয়ে গিয়েছে। তাই শুরু হয়েছে রাসকে সংস্কার করে সময়োপযোগী করে তোলার চেষ্টা। রাস উত্সবের প্রথাগত সূচনা হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতে। সম্প্রতি নবদ্বীপ থানায় রাসের উদ্যোক্তা ও বিভিন্ন দফতরকে নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করে সেই উত্সবের সূচনাকে সরকারি শিলমোহর দিল।
বৈঠকে রাসে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বেশ কিছু নির্দেশিকা ঘোষণা করা হয়। নবদ্বীপে কমবেশি তিনশোর মতো শোভাযাত্রা বা ‘আড়ং’ বের হয়। কিন্তু নানা কারণে বছর কয়েক ধরে আড়ং ক্রমশ গতিহীন হয়ে পড়ছে। চলা শুরু হতে না হতেই দীর্ঘক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে শোভাযাত্রা। অতিরিক্ত ভিড়ে নড়বার কোনও উপায় থাকে না। বৈঠকে ঠিক হয় সেই শোভাযাত্রাকে সচল রাখতে শোভাযাত্রার ৪১০০ মিটার চক্রপথের বিভিন্ন জায়গায় ড্রপগেট ও গার্ডরেল ব্যবহার করা হবে।
নবদ্বীপের আইসি তপনকুমার মিশ্র বলেন, “শোভাযাত্রার চক্রপথে অন্তত কুড়িটি জায়গা দিয়ে প্রতিমা প্রবেশ করে। আর এই প্রবেশ করার ব্যাপারটি বারোয়ারির ইচ্ছা মতো হয়ে থাকে। যার ফলে পুরো ব্যপারটাই কিছুক্ষণের মধ্যে জট পাকিয়ে যায়। কে-কখন কোথা দিয়ে প্রবেশ করবেন তার একটা সময়সারণী আমরা পুরসভা এবং রাসযাত্রা সমন্বয় কমিটির সঙ্গে বসে তৈরি করেছি। উদ্যোক্তাদের পুজোর অনুমতির নেওয়ার সময় ওই সময়সারণী দিয়ে দেওয়া হবে। এরপর বিভিন্ন ড্রপগেট এবং গার্ডরেল খোলা-বন্ধ করে শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হবে।”
এদিনের বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় নিয়মশৃঙ্খলার বিষয়টি। চৈতন্যভূমির এই আশ্চর্য উসবের শরিক হতে প্রায় গোটা বিশ্ব থেকে মানুষজন আসেন। উত্সবে মদ্যপদের বাড়াবাড়ি তাঁদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই দুর্নাম ঘোচাতে বদ্ধপরিকর মন্ত্রী পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা। কঠোর পুলিশ প্রশাসনও। তিনি ওই মঞ্চ থেকে রাস বারোয়ারিগুলির কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “প্রশাসনকে বলেছি, মদ্যপান এবং তার জন্য কোনও ধরনের বিশৃখলা যেন বরদাস্ত না করা হয়। নবদ্বীপের রাসকে সুন্দর করতে আমরা সব ধরনের চেষ্টা করছি। কোনও রকম উচ্ছৃঙ্খলতা দেখলেই কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।” পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা আবার রাস উত্সবকে পুরোপুরি মদবর্জিত করতে উদ্যোক্তাদের কাছে অনুরোধ জানান।
পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ জানান, কোনও অবস্থাতেই আইন শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের ছেড়ে দেওয়া হবে না। এ বার শহর জুড়ে রাসের তিন দিন ছড়ানো থাকবে সাদা পোশাকের পুলিশের নিজস্ব ভিডিওগ্রাফার। তাঁরা সব কিছুরই ছবি তুলে রাখবেন। উত্সবের মধ্যে কাউকে কিছু না বলা হলেও পরে শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের প্রত্যেককে খুঁজে বের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি তিনি প্রতিটি রাস বারোয়ারিকে দশ জনের একটি করে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশের কাছে ওই বাহিনীর নাম এবং ফোন নম্বর জানাতে হবে। বাহিনীর এক জন করে ক্যাপ্টেন থাকবে। তাঁদের কাজ নিজের নিজের বারোয়ারিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার কাজে পুলিশকে সহায়তা করা।
অর্ণববাবু বলেন, “আমার রাসের পরে সেরা তিনটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে জেলা পুলিশের তরফ থেকে পুরস্কৃত করব।” এ ছাড়াও রয়েছে পুরসভা-প্রদত্ত রাস সৃজন সম্মাননা। ওই পুরস্কারে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানাধিকারীদের যথাক্রমে দশ হাজার, আট হাজার এবং ছয় হাজার করে টাকা, ট্রফি এবং শংসাপত্র দেওয়া হবে। প্রতিমা, মণ্ডপ ও শোভাযাত্রার জন্য সেরাদের তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।